ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের তালিকা প্রকাশ করেছেন প্রাক্তন ভারতীয় ক্রিকেটার এবং হেড কোচ রবি শাস্ত্রী (Ravi Shastri)। ‘স্টিক টু ক্রিকেট’ পডকাস্টে মাইকেল ভন, অ্যালিস্টার কুক, ডেভিড লয়েড এবং ফিল টাফনেলের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়ে শাস্ত্রী তার পছন্দের তালিকা ঘোষণা করেন। তবে, তার এই তালিকায় বাদ পড়েছেন ভারতীয় ক্রিকেটের কিংবদন্তি অধিনায়ক সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, রোহিত শর্মা, রাহুল দ্রাবিড় এবং অনিল কুম্বলের মতো দিগ্গজরা। শাস্ত্রীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন সুনীল গাভাসকর, কপিল দেব, সচিন তেন্ডুলকর, বিরাট কোহলি এবং মহেন্দ্র সিং ধোনি।
শাস্ত্রী তার তালিকার শীর্ষে রেখেছেন সচিন তেন্ডুলকরকে। তিনি বলেন, “প্রথম স্থানে থাকবেন তেন্ডুলকর, কারণ তিনি দেশের প্রত্যাশার বোঝা বহন করেছেন এবং ২৪ বছর ধরে ক্রিকেট খেলে ১০০টি শতরান করেছেন। তিনি প্রতিটি দশকের শ্রেষ্ঠ পেস আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছেন। ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস, ইমরান খান থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের স্টুয়ার্ট ব্রড, জেমস অ্যান্ডারসন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার জ্যাক ক্যালিস, শন পোলক, অ্যালান ডোনাল্ডের মতো বোলারদের বিরুদ্ধে খেলেছেন। তার টেকনিক এবং জনপ্রিয়তা অতুলনীয়।”
শাস্ত্রীর এই তালিকা থেকে বাদ পড়া নামগুলির মধ্যে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং রোহিত শর্মার অনুপস্থিতি বিশেষভাবে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ২০০২ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতেছিলেন এবং ২০০৩ ক্রিকেট বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে ভারতীয় ক্রিকেটে এক নতুন যুগের সূচনা হয়, যেখানে তিনি তরুণ প্রতিভাদের পথ দেখিয়েছিলেন। অন্যদিকে, রোহিত শর্মা ২০২৪ সালে আইসিসি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জিতে ভারতকে ১১ বছর পর ট্রফি এনে দিয়েছেন। তিনি ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালেও দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন। তবুও এই দুই সফল অধিনায়ক শাস্ত্রীর তালিকায় স্থান পাননি।
রাহুল দ্রাবিড়, ভারতের টেস্ট ক্রিকেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক এবং সব ফরম্যাট মিলিয়ে তৃতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক, তিনিও শাস্ত্রীর তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন। দ্রাবিড়ের ‘দ্য ওয়াল’ খ্যাতি এবং দলের জন্য তার অবদান ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে অমর। তিনি ২০১১ সালে বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন এবং পরবর্তীতে ভারতের হেড কোচ হিসেবে ২০২৪ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।
অনিল কুম্বলে, ভারতের টেস্ট এবং ওয়ানডে ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী, তিনিও শাস্ত্রীর তালিকায় জায়গা পাননি। কুম্বলের ৬১৯ টেস্ট উইকেট এবং ৩৩৭ ওয়ানডে উইকেট ভারতীয় বোলিংয়ের একটি বিরাট অধ্যায়। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে এক ইনিংসে ১০ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব তার নামে। তবুও শাস্ত্রী তার তালিকায় কুম্বলেকে অন্তর্ভুক্ত করেননি।
শাস্ত্রীর তালিকায় স্থান পাওয়া খেলোয়াড়দের মধ্যে সুনীল গাভাসকর ভারতীয় ব্যাটিংয়ের পথিকৃৎ। তিনি প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ১০,০০০ টেস্ট রানের মাইলফলক স্পর্শ করেন এবং ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য ছিলেন। কপিল দেব, ১৯৮৩ বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক এবং ভারতের প্রথম বিশ্বমানের অলরাউন্ডার, শাস্ত্রীর তালিকায় স্বাভাবিকভাবেই জায়গা করে নিয়েছেন। মহেন্দ্র সিং ধোনি, ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং ২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক, তার নেতৃত্ব এবং ফিনিশিং দক্ষতার জন্য শাস্ত্রীর পছন্দ। বিরাট কোহলি, ভারতের সব ফরম্যাটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক এবং সফলতম টেস্ট অধিনায়ক, শাস্ত্রীর কোচিংয়ের সময় ভারতকে টেস্টে শীর্ষে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ২০১১ বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য এবং ২০১৩ চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ী অধিনায়ক ছিলেন।
শাস্ত্রীর এই তালিকা ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ভারতীয় ক্রিকেটের পুনর্জাগরণ, রোহিত শর্মার সাম্প্রতিক টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়, রাহুল দ্রাবিড়ের অবিচল ব্যাটিং এবং অনিল কুম্বলের অতুলনীয় বোলিং কৃতিত্ব অনেকের মতে তালিকায় স্থান পাওয়ার যোগ্য। তবে, শাস্ত্রীর পছন্দ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং তার সময়ের প্রেক্ষাপটের উপর নির্ভর করেছে। তিনি যে সময়ে কোহলির সঙ্গে কোচ হিসেবে কাজ করেছেন, তা তার তালিকায় কোহলির অন্তর্ভুক্তির একটি কারণ হতে পারে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভক্তরা এই তালিকা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কেউ কেউ শাস্ত্রীর পছন্দের প্রশংসা করলেও, অনেকে সৌরভ, দ্রাবিড় এবং কুম্বলের বাদ পড়াকে ‘অন্যায়’ বলে মনে করছেন। একজন ভক্ত লিখেছেন, “সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় ছাড়া ভারতীয় ক্রিকেটের আধুনিক যুগের কল্পনা করা অসম্ভব। তিনি তালিকায় না থাকায় হতাশ।” আরেকজন লিখেছেন, “কুম্বলের ৬১৯ টেস্ট উইকেট এবং দ্রাবিড়ের ১৩,২৮৮ টেস্ট রান কীভাবে উপেক্ষা করা যায়?”
শাস্ত্রীর এই তালিকা ভারতীয় ক্রিকেটের সমৃদ্ধ ইতিহাসের একটি প্রতিচ্ছবি, তবে এটি একই সঙ্গে প্রশ্ন তুলেছে—কীভাবে মাত্র পাঁচজন ক্রিকেটারের মধ্যে এত বড় ইতিহাসকে সীমাবদ্ধ করা যায়? ভারতীয় ক্রিকেটের প্রতিটি দশকই নতুন কিংবদন্তি তৈরি করেছে, এবং শাস্ত্রীর তালিকা সেই বৈচিত্র্যের একটি অংশ মাত্র প্রতিফলিত করেছে।