পশ্চিমবঙ্গে টেকসই সবজি চাষের জন্য সেরা সঙ্গী ফসল, মিশ্র চাষ ও ইন্টারক্রপিংয়ের সুবিধা

পশ্চিমবঙ্গ ভারতের শীর্ষ সবজি উৎপাদনকারী রাজ্যগুলির মধ্যে একটি, যেখানে প্রায় ১৩.৮০ লাখ হেক্টর জমিতে বার্ষিক ২৫৫ লাখ টন সবজি উৎপাদিত (Vegetable Farming) হয়। এই রাজ্যের…

Best Companion Crops for Sustainable Vegetable Farming in West Bengal: Boost Yields with Intercropping

পশ্চিমবঙ্গ ভারতের শীর্ষ সবজি উৎপাদনকারী রাজ্যগুলির মধ্যে একটি, যেখানে প্রায় ১৩.৮০ লাখ হেক্টর জমিতে বার্ষিক ২৫৫ লাখ টন সবজি উৎপাদিত (Vegetable Farming) হয়। এই রাজ্যের বৈচিত্র্যময় কৃষি-জলবায়ু, উর্বর গাঙ্গেয় পলিমাটি এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য সবজি চাষকে একটি নির্ভরযোগ্য জীবিকা নির্বাহের উপায় করে তুলেছে। তবে, জমির ক্রমবর্ধমান খণ্ডীকরণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মাটির উর্বরতা হ্রাসের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় টেকসই চাষ পদ্ধতির প্রয়োজন। এই প্রেক্ষাপটে, মিশ্র চাষ এবং ইন্টারক্রপিং (সঙ্গী ফসল চাষ) পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য একটি কার্যকর সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই পদ্ধতি শুধু উৎপাদনশীলতা বাড়ায় না, বরং মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করে, কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করে এবং কৃষকদের আয় বৈচিত্র্যকরণে সহায়তা করে।

ইন্টারক্রপিং ও মিশ্র চাষের সুবিধা
ইন্টারক্রপিং হল একটি কাঠামোগত পদ্ধতি, যেখানে দুই বা ততোধিক ফসল একই জমিতে একসঙ্গে পরিকল্পিতভাবে চাষ করা হয়। এটি মিশ্র চাষের থেকে আলাদা, যেখানে ফসলগুলি এলোমেলোভাবে চাষ করা হয়। পশ্চিমবঙ্গের মতো অঞ্চলে, যেখানে জমির পরিমাণ সীমিত এবং কৃষি বৈচিত্র্যময়, ইন্টারক্রপিং নিম্নলিখিত সুবিধাগুলি প্রদান করে:

   
  • উচ্চ ফলন: একই জমিতে একাধিক ফসল চাষের ফলে প্রতি একক এলাকায় ফলন বৃদ্ধি পায়।
  • মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি: শিম জাতীয় ফসলের নাইট্রোজেন ফিক্সেশন মাটির উর্বরতা বাড়ায়।
    কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ: সঙ্গী ফসল কীটপতঙ্গকে বিভ্রান্ত করে এবং উপকারী পোকামাকড়কে আকর্ষণ করে, যার ফলে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কমে।
  • ঝুঁকি হ্রাস: একটি ফসল ব্যর্থ হলেও অন্য ফসল থেকে আয়ের সম্ভাবনা থাকে।
  • বৈচিত্র্য বৃদ্ধি: এটি জৈবিক বৈচিত্র্য বাড়ায় এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।

পশ্চিমবঙ্গে সবজি চাষের জন্য সেরা সঙ্গী ফসল
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা সবজি চাষে ইন্টারক্রপিং ব্যবহার করে উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছেন। নিম্নে কিছু প্রমাণিত সঙ্গী ফসলের সমন্বয় উল্লেখ করা হল:
১. টমেটো + পেঁয়াজ/লালশাক (Onion/Beet Leaf):
টমেটোর সঙ্গে পেঁয়াজ বা লালশাকের ইন্টারক্রপিং অত্যন্ত কার্যকর। পেঁয়াজের তীব্র গন্ধ কীটপতঙ্গকে দূরে রাখে, যা টমেটোর ফলন বাড়ায়। গবেষণায় দেখা গেছে, এক সারি লালশাকের সঙ্গে পেঁয়াজের বীজ ফসল চাষ করলে বীজের ফলন ৪৮৭.৫ কেজি প্রতি হেক্টর এবং বেনিফিট-কস্ট রেশিও ২.৭৬:১ পাওয়া যায়। এই সমন্বয় পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া, মুর্শিদাবাদ এবং উত্তর ২৪ পরগনার কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়।

২. ভুট্টা + শিম (Maize + Beans):
ভুট্টার সঙ্গে ফ্রেঞ্চ বিন বা অন্য শিম জাতীয় ফসলের ইন্টারক্রপিং পুরুলিয়া এবং বাঁকুড়ার মতো জেলায় কার্যকর। শিম মাটিতে নাইট্রোজেন যোগ করে, যা ভুট্টার বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ায় ২০১৫ সালে পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ভুট্টার সঙ্গে ফ্রেঞ্চ বিনের ইন্টারক্রপিংয়ে প্রতি হেক্টরে ৯৪,০৭৯ টাকা নেট আয় হয়, যা একক ভুট্টা চাষের তুলনায় ৭৪% বেশি।

৩. বাঁধাকপি/ফুলকপি + মারিগোল্ড/বেসিল (Cabbage/Cauliflower + Marigold/Basil):
বাঁধাকপি বা ফুলকপির সঙ্গে মারিগোল্ড বা বেসিলের ইন্টারক্রপিং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। মারিগোল্ডের তীব্র গন্ধ হোয়াইটফ্লাই এবং ক্যাবেজ বাটারফ্লাইয়ের মতো কীটপতঙ্গকে দূরে রাখে। দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং উত্তরবঙ্গের কৃষকরা এই পদ্ধতি ব্যবহার করে সফলতা পেয়েছেন। বেসিলের সুগন্ধ টমেটো এবং কপি জাতীয় ফসলের কীটপতঙ্গ কমায়, যা রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার হ্রাস করে।

৪. শসা + সূর্যমুখী (Cucumber + Sunflower):
শসার সঙ্গে সূর্যমুখীর ইন্টারক্রপিং পশ্চিমবঙ্গের উষ্ণ জলবায়ুতে উপযুক্ত। সূর্যমুখী লতানো শসা গাছের জন্য সমর্থন প্রদান করে এবং গ্রীষ্মে ছায়া দেয়। এছাড়া, সূর্যমুখী উপকারী পোকামাকড় যেমন মৌমাছি এবং লেডিবাগকে আকর্ষণ করে, যা পরাগায়নে সহায়তা করে। এই সমন্বয় হুগলি এবং বর্ধমানে জনপ্রিয়।

৫. আলু + শিম/পেঁয়াজ (Potato + Beans/Onion):
আলুর সঙ্গে শিম বা পেঁয়াজের ইন্টারক্রপিং হুগলি এবং বর্ধমানের কৃষকদের মধ্যে প্রচলিত। শিম মাটির নাইট্রোজেনের মাত্রা বাড়ায়, যা আলুর ফলন উন্নত করে। তবে, আলু এবং টমেটো একসঙ্গে চাষ করা উচিত নয়, কারণ এরা একই রোগে আক্রান্ত হতে পারে।

Advertisements

৬. শাকসবজি + ঔষধি গাছ (Leafy Greens + Medicinal Herbs):
পালংশাক, লালশাক বা লেটুসের সঙ্গে পুদিনা, ধনিয়া বা বেসিলের মতো ঔষধি গাছের ইন্টারক্রপিং মাটির বৈচিত্র্য বাড়ায় এবং অতিরিক্ত আয়ের উৎস তৈরি করে। এই গাছগুলি কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে এবং পরাগায়নকারী পোকামাকড়কে আকর্ষণ করে।

পশ্চিমবঙ্গে ইন্টারক্রপিংয়ের চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
ইন্টারক্রপিংয়ের সুবিধা থাকলেও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ফসলের মধ্যে পুষ্টির জন্য প্রতিযোগিতা, সঠিক ব্যবধান নির্ধারণ এবং যান্ত্রিক চাষের অসুবিধা এই পদ্ধতির প্রধান বাধা। এই সমস্যাগুলি মোকাবিলায়

কৃষকদের নিম্নলিখিত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত:

  • সঠিক ফসল নির্বাচন: এমন ফসল বেছে নেওয়া উচিত যেগুলির পুষ্টি ও জলের চাহিদা ভিন্ন এবং বৃদ্ধির সময়কাল আলাদা।
  • ব্যবধান পরিকল্পনা: ফসলের বৃদ্ধির ধরন অনুযায়ী সঠিক ব্যবধান নির্ধারণ করা, যেমন গভীর শিকড়যুক্ত এবং অগভীর শিকড়যুক্ত ফসলের সমন্বয়।
  • জৈব কীটনাশক: মারিগোল্ড বা বেসিলের মতো সঙ্গী ফসল ব্যবহার করে রাসায়নিক কীটনাশকের নির্ভরতা কমানো।
  • প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা: কৃষকদের জন্য সরকারি প্রকল্প যেমন কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র (KVK) বা ICAR-এর প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ।

সরকারি সহায়তা
পশ্চিমবঙ্গে টেকসই কৃষির জন্য সরকারি সহায়তা উল্লেখযোগ্য। জাতীয় টেকসই কৃষি মিশন (NMSA) এবং জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা মিশন (NFSM) ইন্টারক্রপিং এবং ফসল বৈচিত্র্যকরণকে উৎসাহিত করে। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমবঙ্গে সবজি রপ্তানি অঞ্চল (AEZ) নদিয়া, মুর্শিদাবাদ এবং উত্তর ২৪ পরগনায় সবজি চাষকে বাজারমুখী করে তুলেছে। এছাড়া, কৃষকদের জন্য ভর্তুকি এবং প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম ইন্টারক্রপিংয়ের প্রচলন বাড়াচ্ছে।

পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য ইন্টারক্রপিং শুধু একটি কৃষি পদ্ধতি নয়, বরং টেকসই উন্নয়নের একটি দর্শন। টমেটো-পেঁয়াজ, ভুট্টা-শিম, বাঁধাকপি-মারিগোল্ডের মতো সঙ্গী ফসলের সমন্বয় কৃষকদের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা রাখছে। সঠিক পরিকল্পনা, সরকারি সহায়তা এবং কৃষি গবেষণার মাধ্যমে এই পদ্ধতি পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাতকে আরও শক্তিশালী করতে পারে।