২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে কর্পোরেট করের (Tax Cuts For Corporates) বিভিন্ন ছাড় এবং প্রণোদনার কারণে সরকার আনুমানিক ৯৮,৯৯৯ কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী পঙ্কজ চৌধুরী। রাজ্যসভায় একটি লিখিত উত্তরে তিনি জানান, ২০১৯-২০ থেকে ২০২৩-২৪ সময়সীমার মধ্যে কর্পোরেট কর প্রণোদনার ফলে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব হারাতে হয়েছে সরকারকে।
এই তথ্যের ভিত্তিতে বোঝা যাচ্ছে, বিগত পাঁচ বছরে ধাপে ধাপে কর্পোরেট কর হার হ্রাস এবং করছাড়ের সুযোগের ফলে একদিকে যেমন ব্যবসায়িক বিনিয়োগে উৎসাহ জুগিয়েছে, অন্যদিকে তেমনি সরকারকে ছাড় দিতে হয়েছে বহু হাজার কোটি টাকা।
পাঁচ বছরে রাজস্ব হারানোর পরিমাণ:
২০১৯-২০: ৮,০৪৩ কোটি টাকা
২০২০-২১: ৭৫,২১৮ কোটি টাকা
২০২১-২২: ৯৬,৮৯২ কোটি টাকা
২০২২-২৩: ৮৮,১০৯ কোটি টাকা
২০২৩-২৪: ৯৮,৯৯৯ কোটি টাকা
এর মানে পাঁচ বছরে মোট রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৩,৬৭,২৬১ কোটি টাকা।
কর্পোরেট কর হ্রাসের পেছনের যুক্তি:
সরকারের তরফ থেকে জানানো হয়েছে যে, ২০১৬ সালের ফাইনান্স অ্যাক্ট মারফত কর্পোরেট কর ধাপে ধাপে হ্রাস করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল—অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে লগ্নি বাড়ানো।
২০১৬ সালে, কর্পোরেট কর ৩০ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ২৯ শতাংশ করা হয়।
২০১৭ সালে, বাৎসরিক টার্নওভার ৫০ কোটি টাকার কম এমন ক্ষুদ্র সংস্থার কর হার ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়, যাতে তারা কোম্পানি কাঠামোয় রূপান্তরিত হয়ে আরও বেশি ব্যবসায়িক কার্যক্রমে যুক্ত হতে পারে।
২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে, বিদ্যমান কোম্পানিগুলির জন্য কর হার ৩০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২২ শতাংশ করা হয় এবং ২০১৯ সালের ১ অক্টোবরের পর প্রতিষ্ঠিত নতুন উৎপাদন সংস্থার জন্য কর হার ১৫ শতাংশ করা হয়। তবে শর্ত ছিল—এই সংস্থাগুলিকে সমস্ত করছাড় ও প্রণোদনা ত্যাগ করতে হবে।
২০২৪ সালের ফাইনান্স অ্যাক্ট অনুযায়ী, বিদেশি কোম্পানির (বিশেষ হারে করযোগ্য নয় এমন আয়ের ক্ষেত্রে) কর হার ৪০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়েছে, যাতে বিদেশি বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান বাড়ে।
বিরোধীদের উদ্বেগ:
এই করছাড় নীতির ফলে একদিকে যেমন ব্যবসায়িক পরিকাঠামোতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে, অন্যদিকে বিরোধীরা একে সরকারের “কর্পোরেট ঘেঁষা নীতি” বলে সমালোচনা করেছে। রাজ্যসভায় আম আদমি পার্টির সাংসদ রাঘব চাড্ডা প্রশ্ন তোলেন, ২০১৯-২০ থেকে ২০২৪-২৫ পর্যন্ত কর্পোরেট কর কমানোর ফলে ঠিক কতটা রাজস্ব হারাতে হয়েছে।
পাল্টা জবাবে পঙ্কজ চৌধুরী বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে এখনো পর্যন্ত কর হারানো সংক্রান্ত চূড়ান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি।
কী বলছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা?
অর্থনীতিবিদদের মতে, দীর্ঘমেয়াদে কর হ্রাসে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নত হয়, বিনিয়োগ আকর্ষিত হয় এবং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সরকার যদি এই কর হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে রাজস্বের বিকল্প উৎস না গড়ে তোলে, তাহলে উন্নয়নমূলক প্রকল্পগুলি ব্যাহত হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, কর ছাড় দেওয়া মানে শুধুমাত্র রাজস্ব কমা নয়, বরং সেই কর ছাড়ের ফলে যে বাড়তি লগ্নি ও কর্মসংস্থান তৈরি হয়, তা দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে সচল রাখতে সহায়তা করে।
ভবিষ্যতের দিশা:
বর্তমান পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকার হয়তো নতুন কোনও “উৎসাহ প্রকল্প” (incentive scheme) চালু না করলেও, কর হ্রাসের নীতিকে কিছুটা সময়ের জন্য স্থিতিশীল রাখতে চাইছে। বিশেষ করে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সময় এই ধরণের করছাড় বিদেশি এবং দেশীয় দুই ধরনের বিনিয়োগকারীর কাছেই ভারতের প্রতি আস্থা বাড়াতে পারে।
কর্পোরেট কর ছাড়ের ফলে ভারতের কর কাঠামো অনেক বেশি প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে, তবে এই ছাড়ের ফলে যে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার, তা দীর্ঘমেয়াদে রাজকোষ ঘাটতির দিকে ঠেলে দিতে পারে। তাই ভবিষ্যতে কর নীতিতে আরও সূক্ষ্ম ভারসাম্য রক্ষা করা প্রয়োজন বলেই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।