এল নিনো (El Niño) একটি জলবায়ু ঘটনা যা প্রশান্ত মহাসাগরের পৃষ্ঠের জলের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বিশ্বব্যাপী আবহাওয়ার ধরণে পরিবর্তন আনে, ভারতের কৃষি খাতে, বিশেষ করে ধান চাষীদের উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলছে। ভারতের প্রায় ১২০ মিলিয়ন কৃষকের জন্য বর্ষা ঋতু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দেশের প্রায় ৫০% কৃষিজমি বর্ষার উপর নির্ভরশীল। এল নিনোর প্রভাবে বর্ষার বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এবং বিতরণে অনিয়ম দেখা দেয়, যা ধান চাষীদের জন্য ফসল উৎপাদন, জলের ঘাটতি এবং অর্থনৈতিক ক্ষতির মতো সমস্যা সৃষ্টি করে। ২০২৫ সালে এল নিনোর সম্ভাব্য প্রভাব এবং এর ফলে ধান চাষীদের মুখোমুখি হতে হবে এমন চ্যালেঞ্জ নিয়ে এই প্রতিবেদনে আলোচনা করা হল।
এল নিনোর প্রভাব এবং বর্ষার অনিয়ম
এল নিনো একটি জলবায়ু ঘটনা যেখানে প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্য ও পূর্বাঞ্চলের সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়। এটি ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম বর্ষার প্রবাহকে দুর্বল করে, যার ফলে বৃষ্টিপাত কমে যায় বা অনিয়মিত হয়। ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগ (IMD) জানিয়েছে যে এল নিনোর বছরগুলিতে, যেমন ২০০২, ২০০৯, ২০১৪ এবং ২০১৫ সালে, ভারত ব্যাপক খরার সম্মুখীন হয়েছে। এই খরা ধান, মাটির আর্দ্রতা এবং ফসলের বৃদ্ধির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে, যা দেশের প্রধান ধান উৎপাদনকারী রাজ্যগুলি যেমন পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, মহারাষ্ট্র এবং কর্ণাটকে কৃষকদের জন্য ক্ষতিকর।
২০২৫ সালে, এল নিনোর প্রভাবে বর্ষার বৃষ্টিপাতের পরিমাণ স্বাভাবিকের তুলনায় কম হতে পারে। এটি ধান চাষীদের জন্য বিশেষভাবে উদ্বেগজনক কারণ ধান একটি অত্যন্ত জল-নির্ভর ফসল। ঐতিহ্যগতভাবে ধান চাষে চারা রোপণের জন্য নার্সারি তৈরি করা হয় এবং তারপর প্রধান ক্ষেত্রে পুনরায় রোপণ করা হয়, যার জন্য প্রচুর পরিমাণে জলের প্রয়োজন। এল নিনোর কারণে বৃষ্টিপাত কমে গেলে, কৃষকরা সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ জলের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হন, যা ইতিমধ্যেই উত্তর ভারতের ইন্দো-গঙ্গা সমভূমিতে কমে যাওয়া ভূগর্ভস্থ জলের স্তরকে আরও হ্রাস করে।
ধান চাষীদের মুখোমুখি সমস্যা
১. জলের ঘাটতি: এল নিনোর ফলে কম বৃষ্টিপাত ধান চাষের জন্য প্রয়োজনীয় জলের প্রাপ্যতাকে সীমিত করে। এটি ফসলের বৃদ্ধিকে বাধাগ্রস্ত করে এবং ফলন হ্রাস করে। উদাহরণস্বরূপ, হরিয়ানার নদিয়ালি গ্রামের কৃষক শেরপুরি গোস্বামীর মতো ক্ষুদ্র কৃষকরা, যিনি এক হেক্টরেরও কম জমির মালিক, তিনি ধান চাষের জন্য ভূগর্ভস্থ জলের উপর নির্ভর করেন। ২০২৪ সালে, হরিয়ানায় বর্ষার বৃষ্টিপাত ১৮%inione
২. ফসলের ক্ষতি: অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত ধানের চারা শুকিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়, যা ফসলের ব্যাপক ক্ষতির কারণ হতে পারে। ২০২৩ সালে, এল নিনোর প্রভাবে বিলম্বিত বর্ষার ফলে ধানের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, এবং ২০২৫ সালেও একই ধরনের পরিস্থিতি হতে পারে।
৩. অর্থনৈতিক ক্ষতি: ধানের ফলন কমে গেলে কৃষকদের আয় হ্রাস পায়, যা তাদের জীবিকার উপর প্রভাব ফেলে। এটি খাদ্য মূল্যস্ফীতি এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণ হতে পারে, কারণ ভারত বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ধান রপ্তানিকারক দেশগুলির মধ্যে একটি।
৪. মাটির ক্ষয় এবং কীটপতঙ্গ: এল নিনোর কারণে উষ্ণ তাপমাত্রা এবং পরিবর্তিত বৃষ্টিপাতের ধরণ কীটপতঙ্গের জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হতে পারে, যা ধান ফসলের জন্য অতিরিক্ত হুমকি।
কৃষকদের জন্য সমাধান ও সরকারি উদ্যোগ
এল নিনোর প্রভাব মোকাবেলায় ভারত সরকার এবং বিভিন্ন সংস্থা জলবায়ু-প্রতিরোধী কৃষি পদ্ধতির প্রচার করছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- জল সংরক্ষণ: বৃষ্টির জল সংরক্ষণ এবং ভূগর্ভস্থ জল পুনর্ভরণের মতো পদ্ধতি কৃষকদের জলের ঘাটতি মোকাবেলায় সহায়তা করতে পারে।
- খরা-প্রতিরোধী ফসল: খরা-সহনশীল ধানের জাত ব্যবহার করা যেতে পারে যা কম জলের প্রয়োজন হয়।
- ডিএসআর পদ্ধতি: ডিরেক্ট সিডিং অফ রাইস (DSR) পদ্ধতি জলের ব্যবহার কমাতে সহায়ক হতে পারে, যা এল নিনোর মতো পরিস্থিতিতে কার্যকর।
- কৃষি বীমা: প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার মাধ্যমে কৃষকদের ফসলের ক্ষতির জন্য আর্থিক সুরক্ষা প্রদান করা হয়।
কৃষকদের প্রতিক্রিয়া এবং অভিযোজন
কৃষকরা এল নিনোর প্রভাব মোকাবেলায় বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছেন। উদাহরণস্বরূপ, হরিয়ানার কৃষক মালাক সিং ডিএসআর পদ্ধতি ব্যবহার করে জলের ব্যবহার কমিয়েছেন। তবে, কৃষকদের মধ্যে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের হার এখনও কম, কারণ জলবায়ু-স্মার্ট প্রযুক্তির বাণিজ্যিক প্রণোদনা সীমিত।
২০২৫ সালে এল নিনোর প্রভাব ভারতের ধান চাষীদের জন্য উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করতে পারে। কম বৃষ্টিপাত, জলের ঘাটতি, ফসলের ক্ষতি এবং অর্থনৈতিক চাপ কৃষকদের জীবিকার উপর প্রভাব ফেলবে। তবে, জলবায়ু-প্রতিরোধী কৃষি পদ্ধতি, সরকারি উদ্যোগ এবং কৃষকদের অভিযোজন কৌশল এই প্রভাব কমাতে সহায়ক হতে পারে। কৃষকদের তথ্য, ঋণ এবং প্রযুক্তির প্রতি অধিকতর প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে চলার জন্য সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।