ভারতের ইউনিফাইড পেমেন্ট ইন্টারফেস (UPI) এখন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় রিয়েল-টাইম পেমেন্ট প্রযুক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ইউপিআই দৈনিক ৬৪০ মিলিয়নেরও বেশি লেনদেন প্রক্রিয়াকরণ করে, যা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ভিসাকে (Visa) ছাড়িয়ে গেছে। এই সাফল্য ভারতের জন্য এক বড় আন্তর্জাতিক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
প্রতিবেদনটির শিরোনাম — “Growing Retail Digital Payments: The Value of Interoperability” — তে উল্লেখ করা হয় যে, ভারতে ডিজিটাল লেনদেনের ৮৫ শতাংশ এবং বিশ্বব্যাপী প্রায় ৬০ শতাংশ লেনদেন ইউপিআই-এর মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে।
ইউপিআই-এর অসাধারণ পরিসংখ্যান:
২০২৫ সালের জুন মাসে ইউপিআই-এর মাধ্যমে মোট ১৮.৩৯ বিলিয়ন লেনদেন হয়েছে, যার আর্থিক মূল্য ছিল প্রায় ₹২৪ লাখ কোটি। এই সংখ্যা ২০২৪ সালের জুনে ছিল ১৩.৮৮ বিলিয়ন, অর্থাৎ বছরে বছরে প্রায় ৩২ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। একমাত্র জুন মাসেই ইউপিআই পরিচালনা করেছে দৈনিক গড়ে ৬৪০ মিলিয়নেরও বেশি লেনদেন, যা ভিসার দৈনিক ৬৩৯ মিলিয়ন লেনদেনকেও ছাড়িয়ে গেছে।
মাত্র ৯ বছরের মধ্যে এমন ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ও ব্যবহার অর্জন করা ইউপিআই-এর জন্য একটি অনন্য অর্জন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “বিশ্বের যেকোনো ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থার তুলনায় ইউপিআই সবচেয়ে দ্রুতগতিতে এই পর্যায়ে পৌঁছেছে।”
ইউপিআই কীভাবে কাজ করে?
ইউপিআই একটি রিয়েল-টাইম পেমেন্ট ব্যবস্থা, যা ব্যবহারকারীদের মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মধ্যে টাকা স্থানান্তর করার সুবিধা দেয়। এটি ইমিডিয়েট পেমেন্ট সার্ভিস (IMPS) পরিকাঠামোর উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। ইউপিআই-এর মাধ্যমে একাধিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট একটিমাত্র অ্যাপ্লিকেশনেই সংযুক্ত করা যায়। এতে পিয়ার-টু-পিয়ার ফান্ড ট্রান্সফার, মার্চেন্ট পেমেন্ট, বিল পেমেন্ট, এমনকি পেমেন্ট অনুরোধ পাঠানোর মতো নানা বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
বৈশ্বিক পরিসরে ইউপিআই-এর সম্প্রসারণ:
আইএমএফ-এর মতে, ইউপিআই এখন কেবলমাত্র ভারতের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। ইতিমধ্যে এটি সাতটি দেশে চালু হয়েছে — সংযুক্ত আরব আমিরাত (UAE), সিঙ্গাপুর, ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ফ্রান্স এবং মরিশাস।
বিশেষত ফ্রান্সে ইউপিআই-এর সূচনা ইউরোপে ভারতের ডিজিটাল প্রযুক্তির পদার্পণ হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। এতে করে ফ্রান্সে বসবাসরত বা সফররত ভারতীয়রা সহজেই ইউপিআই ব্যবহার করে বিদেশে পেমেন্ট করতে পারবে, বিদেশি মুদ্রা বিনিময়ের ঝামেলা ছাড়াই।
ভারত এখন ব্রিকস (BRICS) গোষ্ঠীর নতুন ছয় সদস্য-সহ মোট ১১টি দেশের মধ্যে ইউপিআই-কে একটি মানক পেমেন্ট ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। আইএমএফ জানিয়েছে, এই প্রচেষ্টা সফল হলে আন্তঃদেশীয় রেমিট্যান্সে স্বচ্ছতা আসবে, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি পাবে এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারত প্রযুক্তিনির্ভর নেতৃত্বে নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে।
ইউপিআই-এর সাফল্যের গোপন রহস্য:
আইএমএফ-এর মতে, ইউপিআই-এর মূল সাফল্যের রহস্য হলো এর ইন্টারঅপারেবিলিটি বা আন্তঃযোগাযোগ ব্যবস্থা। ইউপিআই সমস্ত ব্যাঙ্ক এবং ফিনটেক অ্যাপগুলিকে একটি সাধারণ প্ল্যাটফর্মে সংযুক্ত করেছে, যা পরিচালনা করে ন্যাশনাল পেমেন্টস কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (NPCI)।
এই উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্ম ব্যবস্থার দুইটি গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা রয়েছে:
1. ব্যবহারকারীরা নিজেদের পছন্দের অ্যাপ বেছে নিতে পারেন — যেটি তাদের কাছে বেশি সহজ, নির্ভরযোগ্য বা নিরাপদ মনে হয়।
2. একাধিক পেমেন্ট পরিষেবা প্রদানকারীর মধ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়, যা সেবা, নিরাপত্তা এবং উদ্ভাবনে উন্নয়ন ঘটায়।
প্রধানমন্ত্রী ও বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া:
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একাধিকবার ইউপিআই-কে “ভারতের ডিজিটাল গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড” বলে অভিহিত করেছেন। ডিজিটাল ইন্ডিয়া মিশনের সফল বাস্তবায়নে ইউপিআই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, ইউপিআই শুধু একটি প্রযুক্তি নয়, এটি একটি আর্থিক বিপ্লব। গ্রামীণ অঞ্চল থেকে শুরু করে শহরের বাজার, ছোট দোকান থেকে অনলাইন শপিং— সর্বত্র ইউপিআই ব্যবহৃত হচ্ছে, যা কাগজবিহীন ও ক্যাশলেস অর্থনীতিকে বাস্তব রূপ দিচ্ছে।
ইউপিআই-এর এই বৈশ্বিক স্বীকৃতি ভারতকে ডিজিটাল অর্থনীতির অগ্রদূত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের স্বীকৃতি প্রমাণ করে যে, ভারতের উদ্ভাবনী শক্তি শুধু দেশেই নয়, বিশ্বের অর্থনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলতে সক্ষম।
ডিজিটাল লেনদেনের ভবিষ্যৎ যে আরও উজ্জ্বল ও বিশ্বব্যাপী হবে, তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই। ইউপিআই-এর এই যাত্রা কেবল শুরু — এর বিস্তার ও প্রভাব আগামী দশকে নতুন মাত্রায় পৌঁছাতে প্রস্তুত।