পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Banerjee)২১ জুলাই শহীদ দিবসের মঞ্চ থেকে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ ও ওড়িশার ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানিয়েছেন। ধর্মতলার জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে তিনি বিজেপির দুর্নীতি, অপরাধ, এবং বাঙালি সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচারের একটি বিস্তৃত খতিয়ান তুলে ধরেছেন।
মমতার বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে যে, তিনি বিজেপির বাংলা-বিরোধী নীতি এবং অন্যান্য রাজ্যে বাঙালিদের হেনস্থার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তাঁর বক্তব্যে উত্তর প্রদেশকে ‘অপরাধের খনি’ এবং ওড়িশায় নারী ও শিশুদের উপর অত্যাচারের অভিযোগ তুলে তিনি বিজেপির শাসনব্যবস্থার তীব্র সমালোচনা করেছেন।
উত্তর প্রদেশ: অপরাধের খনি
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বক্তব্যে উত্তর প্রদেশকে ‘অপরাধের খনি’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, বিজেপির ডবল ইঞ্জিন সরকারের অধীনে এই রাজ্যে অপরাধের হার আকাশচুম্বী হয়েছে। তিনি অভিযোগ করেছেন, উত্তর প্রদেশে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, এবং খুনের মতো ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে, যার জন্য বিজেপি সরকারের দুর্নীতিপূর্ণ প্রশাসন দায়ী।
মমতা বলেন, “উত্তর প্রদেশে বিজেপি সরকারের অধীনে আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। মানুষের জীবন ও সম্পত্তি নিরাপদ নয়। নারীদের উপর অত্যাচারের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে, আর বিজেপি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।”
তিনি আরও অভিযোগ করেছেন যে, বিজেপি সরকার দুর্নীতির মাধ্যমে রাজ্যের সম্পদ লুট করছে এবং সাধারণ মানুষের উন্নয়নের জন্য কোনো কাজ করছে না। মমতার এই বক্তব্য উত্তর প্রদেশের বিজেপি সরকারের প্রতি তাঁর ক্ষোভ এবং তৃণমূলের রাজনৈতিক অবস্থানকে আরও স্পষ্ট করেছে।
ওড়িশায় নারী ও শিশুদের উপর অত্যাচার
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ওড়িশার বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধেও তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, “ওড়িশায় বাচ্চা মেয়েদের উপর অত্যাচার করা হচ্ছে। এমনকি জীবন্ত পুড়িয়ে দেওয়ার মতো জঘন্য অপরাধও ঘটছে। বিজেপি এই অপরাধগুলোকে মদত দিচ্ছে।” তিনি ওড়িশায় নারী ও শিশুদের উপর অত্যাচারের ঘটনাগুলো তুলে ধরে বলেন, এই রাজ্যে বিজেপির ডবল ইঞ্জিন সরকার সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি অভিযোগ করেছেন, বিজেপি শুধুমাত্র নির্বাচনের সময় মানুষের কাছে ভোটের জন্য যায়, কিন্তু ক্ষমতায় এসে সাধারণ মানুষের জন্য কিছুই করে না। মমতার এই বক্তব্য ওড়িশার বিজেপি সরকারের প্রতি তাঁর তীব্র ক্ষোভ এবং বাঙালি সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁদের অবহেলার প্রতিবাদ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
দিল্লিতে জল ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিল্লির জয় হিন্দ কলোনির বাঙালি সম্প্রদায়ের উপর হেনস্থার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, “বিজেপি শাসিত দিল্লিতে বাঙালিদের জল ও বিদ্যুৎ সংযোগ কেটে দেওয়া হচ্ছে। পানীয় জল পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে না। এটা কি গণতন্ত্র?” তিনি অভিযোগ করেছেন, বাঙালিদের বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণে তাদের ‘বাংলাদেশি’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে এবং তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
মমতা বলেন, “বাঙালিরা ভারতের নাগরিক, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে গর্ব করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু বিজেপি তাদের উপর জুলুম করছে।” তিনি দিল্লির জয় হিন্দ কলোনির বাসিন্দাদের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং বলেছেন, “আমরা এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করব।”
মতুয়া সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির বিরুদ্ধে মতুয়া সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচারের অভিযোগ তুলেছেন। তিনি বলেন, “মতুয়ারা বিজেপিকে ভোট দিয়েছে, কিন্তু ভোটের পর তাদেরও আটক করা হচ্ছে। শুধুমাত্র বাঙালি বলে তাদের উপর অত্যাচার করা হচ্ছে।” তিনি অভিযোগ করেছেন, বিজেপি নির্বাচনের সময় মতুয়া সম্প্রদায়ের কাছে গিয়ে ভোট চায়, কিন্তু ক্ষমতায় এসে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে।
মমতার এই বক্তব্য মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে, যারা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তিনি বলেন, “বাঙালিরা যেখানেই থাকুক, তাদের সম্মান ও অধিকার রক্ষার জন্য তৃণমূল কংগ্রেস সবসময় পাশে থাকবে।”
শহীদ দিবসের তাৎপর্য ও মমতার বার্তা
২১ জুলাই শহীদ দিবস পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। ১৯৯৩ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে যুব কংগ্রেসের একটি শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশের গুলিতে ১৩ জন শহীদ হন। এই ঘটনা তৃণমূল কংগ্রেসের জন্মের পথ প্রশস্ত করে। এই দিনে ধর্মতলায় লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে, যারা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এবং তৃণমূলের নেতৃত্বের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করতে আসে।
মমতা তাঁর বক্তব্যে বলেন, “শহীদদের আত্মত্যাগ আমাদের গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ের প্রেরণা। আমরা বাংলার মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য সবসময় লড়াই করব।” তিনি দলের কর্মী-সমর্থকদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন এবং বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই আরও জোরদার করার নির্দেশ দিয়েছেন।
পাকিস্তান নয় এবার, ভারতের কাঁটা প্রতিবেশী বাংলাদেশ!
বিজেপির প্রতিক্রিয়া
মমতার এই বক্তব্যের পর বিজেপি নেতারা পাল্টা সমালোচনা করেছেন। বিজেপির একজন মুখপাত্র বলেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শহীদ দিবসকে রাজনৈতিক প্রচারের জন্য ব্যবহার করছেন। তিনি বিজেপির বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরানোর চেষ্টা করছেন।”
তবে, তৃণমূল কংগ্রেস এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাঙালিদের অধিকার ও সম্মান রক্ষার জন্য সোচ্চার হয়েছেন, এবং বিজেপির বাংলা-বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে তাঁর এই অবস্থান জনগণের সমর্থন পাচ্ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শহীদ দিবসের বক্তব্য বাংলার রাজনীতিতে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে।
উত্তর প্রদেশ, ওড়িশা, এবং দিল্লিতে বাঙালিদের উপর অত্যাচার, বিজেপির ডবল ইঞ্জিন সরকারের দুর্নীতি ও অপরাধের খতিয়ান তুলে ধরে তিনি স্পষ্ট করেছেন যে, তৃণমূল কংগ্রেস এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে চুপ করে থাকবে না।
তাঁর বার্তা বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা সঞ্চার করেছে এবং বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ের নতুন দিশা দেখিয়েছে। ধর্মতলার জনসমুদ্র প্রমাণ করে যে, বাংলার মানুষ মমতার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ এবং তাদের অধিকার রক্ষার জন্য প্রস্তুত।