ভারতের কৃষি রপ্তানি (India Agricultural Exports) ২০২৫ সালে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে, যা দেশের অর্থনীতি এবং কৃষকদের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন। কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্য রপ্তানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এপিইডিএ) এবং সাম্প্রতিক সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন ২০২৫) ভারতের কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্য রপ্তানি ৭ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়ে ৫.৯৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। এই বৃদ্ধির পিছনে রয়েছে ধান, মাংস, ফলমূল এবং সবজির শক্তিশালী রপ্তানি। এই রেকর্ড রপ্তানি কেবল কৃষকদের আয় বাড়াচ্ছে না, বরং ভারতের বিশ্ব বাণিজ্যে অবস্থানকে আরও শক্তিশালী করছে। এই প্রতিবেদনে আমরা এই রপ্তানি বৃদ্ধির কারণ, এর প্রভাব এবং এর ফলে সাধারণ মানুষের জন্য কী অর্থ বহন করে তা বিশ্লেষণ করব।
কৃষি রপ্তানির বৃদ্ধির পিছনে কারণ
ভারতের কৃষি রপ্তানি ২০২৫ সালে একটি নতুন মাইলফলক স্পর্শ করেছে, যা বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং সরকারের রপ্তানি-উৎসাহিত নীতির ফল। এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত ভারতের কৃষি পণ্য রপ্তানির মোট মূল্য ছিল ৩,১৮,৫০৯ কোটি টাকা (৩৬.৯৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। এই বৃদ্ধি বিশেষত ধান, মশলা, কফি এবং তামাক রপ্তানির কারণে সম্ভব হয়েছে। ধান ভারতের সবচেয়ে বড় রপ্তানি পণ্য, যা মোট কৃষি রপ্তানির ২০ শতাংশেরও বেশি অবদান রাখে। ২০২৪-২৫ সালের প্রথম আট মাসে (এপ্রিল-নভেম্বর ২০২৪) ধান রপ্তানি ১৩ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া, ব্রাজিল, ভিয়েতনাম এবং জিম্বাবুয়ের মতো দেশে ফসলের ক্ষতির কারণে ভারতের কফি এবং তামাক রপ্তানি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।
মশলার রপ্তানিও রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে, বিশেষ করে বাসমতি ধান, মরিচ, হলুদ, জিরা এবং ধনে। সমুদ্রজাত পণ্য, যেমন চিংড়ি, পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, তামিলনাড়ু, কেরল, মহারাষ্ট্র এবং গুজরাটের কৃষকদের জন্য উল্লেখযোগ্য আয়ের উৎস হয়ে উঠেছে। ২০২৩-২৪ সালে সমুদ্রজাত পণ্য রপ্তানি ৮.০৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছিল। সরকারের কৃষি রপ্তানি নীতি (এইপি) এবং এপিইডিএ-র উদ্যোগ, যেমন বিভিন্ন দেশে বিটুবি প্রদর্শনী এবং নতুন বাজার অনুসন্ধান, এই বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
কৃষকদের জন্য এর অর্থ কী?
এই রেকর্ড রপ্তানি কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে সরাসরি প্রভাব ফেলছে। ধান, মশলা, কফি এবং সমুদ্রজাত পণ্যের বর্ধিত চাহিদা কৃষকদের জন্য উচ্চতর মূল্য এবং বাজার সুযোগ নিয়ে এসেছে। উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যগুলি, যেখানে ধান এবং গমের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি, এই রপ্তানি বৃদ্ধির প্রধান সুবিধাভোগী। উত্তর প্রদেশ, যা ভারতের আখ উৎপাদনের ৪৮ শতাংশ অবদান রাখে, এই রপ্তানি বৃদ্ধির ফলে কৃষকদের আয়ে ইতিবাচক প্রভাব দেখছে।
সরকারের ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (এমএসপি) নীতি এবং কৃষি রপ্তানি প্রচারের উদ্যোগ কৃষকদের উৎসাহিত করেছে বেশি উৎপাদন করতে। এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী ধান-ধান্য কৃষি যোজনা, যা ২০২৫-২৬ রবি মরসুম থেকে ১০০টি নিম্ন-কার্যক্ষম জেলায় ফসলের উৎপাদন এবং কৃষকদের আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে চালু হয়েছে, এই প্রচেষ্টাকে আরও শক্তিশালী করছে। এই প্রকল্পটি প্রায় ১.৭ কোটি কৃষককে উপকৃত করবে, যা কৃষি খাতে নতুন গতি সঞ্চার করবে।
চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
যদিও কৃষি রপ্তানি রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বিশ্ব বাজারে কঠোর স্যানিটারি এবং ফাইটোস্যানিটারি (এসপিএস) মান, যেমন ইউরোপে বাসমতি ধান এবং চায়ের উপর কীটনাশক সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা, ভারতীয় রপ্তানির জন্য বাধা সৃষ্টি করছে। জাপানের ফুলের রপ্তানির উপর কঠোর কীটপতঙ্গ নিয়ম ভারতের ফ্লোরিকালচার রপ্তানিকে প্রভাবিত করেছে। এছাড়া, বিশ্ব বাজারে দামের অস্থিরতা এবং ভারতের ধান ও চিনির মতো পণ্যের উপর রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা ভারতের বিশ্বস্ততার উপর প্রশ্ন তুলেছে।
২০২৩-২৪ সালে ধান এবং চিনির রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে রপ্তানি মূল্য কমেছে, যদিও বাসমতি ধান এবং মশলার রপ্তানি শক্তিশালী রয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও) ভারতের এমএসপি নীতির সমালোচনা করেছে, যা ভারতের রপ্তানি প্রতিযোগিতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। তবে, সরকার নতুন বাজার যেমন আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে দুগ্ধ, পোলট্রি, শাকসবজি এবং ফলমূলের রপ্তানি বাড়ানোর উপর জোর দিচ্ছে। এছাড়া, জৈব পণ্য এবং মিলেটের মতো সুপারফুডের ক্রমবর্ধমান চাহিদা ভারতের জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করছে।
সাধারণ মানুষের জন্য এর অর্থ কী?
এই রপ্তানি বৃদ্ধি কেবল কৃষকদের জন্যই নয়, সাধারণ মানুষের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি রপ্তানির বৃদ্ধি অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে, যা কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং অবকাঠামো উন্নয়নে অবদান রাখে। তবে, কৃষি আমদানি, বিশেষ করে ভোজ্য তেল এবং ডালের আমদানি বৃদ্ধি, দেশের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত হ্রাস করছে। ২০২৪-২৫ সালের এপ্রিল-ডিসেম্বরে কৃষি আমদানি ১৮.৭ শতাংশ বেড়ে ২৯.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে, যা কৃষি বাণিজ্য উদ্বৃত্তকে ৮.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নামিয়ে এনেছে। এটি ভোক্তাদের জন্য খাদ্য মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
তবে, সরকারের কৃষি-প্রযুক্তি স্টার্টআপ এবং জৈব চাষের উপর জোর দেওয়া ভবিষ্যতে খাদ্য নিরাপত্তা এবং টেকসই চাষের জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ। কৃষকদের জন্য উন্নত সেচ, স্টোরেজ অবকাঠামো এবং ক্রেডিট সুবিধা কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করবে, যা দীর্ঘমেয়াদে দাম স্থিতিশীল রাখতে পারে।
২০২৫ সালে ভারতের কৃষি রপ্তানির রেকর্ড বৃদ্ধি দেশের কৃষি খাতের শক্তি এবং সম্ভাবনার প্রমাণ। ধান, মশলা, কফি এবং সমুদ্রজাত পণ্যের শক্তিশালী রপ্তানি ভারতকে বিশ্ব বাজারে একটি শক্তিশালী খেলোয়াড় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবে, আমদানি বৃদ্ধি এবং বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সরকারকে আরও কার্যকর নীতি গ্রহণ করতে হবে। এই রপ্তানি বৃদ্ধি কৃষকদের জন্য উচ্চতর আয় এবং সাধারণ মানুষের জন্য অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করছে, তবে টেকসই উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।