পশ্চিমবঙ্গ তার উর্বর মাটি এবং বৈচিত্র্যময় জলবায়ুর কারণে, জৈব সবজি চাষের জন্য একটি আদর্শ স্থান। জলবায়ু পরিবর্তন, মাটির স্বাস্থ্য হ্রাস এবং ভোক্তাদের মধ্যে জৈব পণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার জৈব কৃষি (Organic Vegetable Farming) প্রচারে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে। ২০২৫ সালে, সরকার কৃষকদের জন্য সাবসিডি, প্রশিক্ষণ, এবং সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জৈব সবজি চাষকে উৎসাহিত করছে। এই প্রতিবেদনে, আমরা পশ্চিমবঙ্গে জৈব সবজি চাষ শুরু করার জন্য ধাপে ধাপে সরকারি নির্দেশিকা এবং প্রয়োজনীয় তথ্য নিয়ে আলোচনা করব।
জৈব সবজি চাষ কী এবং কেন এটি গুরুত্বপূর্ণ?
জৈব সবজি চাষ হল এমন একটি কৃষি পদ্ধতি যেখানে রাসায়নিক সার, কীটনাশক বা জিনগতভাবে পরিবর্তিত বীজের পরিবরনতা ব্যবহার করা হয়। এর পরিবর্তে, জৈব সার, জৈব কীটনাশক এবং ফসলের অবশিষ্টাংশ ব্যবহার করা হয় মাটির উর্বরতা এবং পরিবেশের স্থায়িত্ব বজায় রাখতে। পশ্চিমবঙ্গে, জৈব সবজির চাহিদা, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে, দ্রুত বাড়ছে। এই চাহিদা পূরণ করতে এবং মাটির স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য, সরকার জৈব কৃষি নীতি প্রণয়ন করেছে, যা কৃষকদের প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।
ধাপে ধাপে জৈব সবজি চাষ শুরু করার নির্দেশিকা
পশ্চিমবঙ্গে জৈব সবজি চাষ শুরু করতে নিম্নলিখিত ধাপগুলি অনুসরণ করুন:
- জমি নির্বাচন করুন:
জৈব সবজি চাষের জন্য দোআঁশ মাটি (loamy soil) আদর্শ, কারণ এটি জল ধরে রাখে এবং পুষ্টি সরবরাহ করে। কাদামাটির মতো মাটি এড়িয়ে চলুন।
নিশ্চিত করুন জমি রাসায়নিক দূষণমুক্ত এবং র নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো।
জমি প্রস্তুতির জন্য জৈব সার (vermicompost, cow dung) ব্যবহার করুন। জমি প্রস্তুতির খরচ প্রায় ৩০,০০০ থেকে ৪০,০০০ টাকা হতে পারে। - উপযুক্ত সবজি নির্বাচন করুন:
পশ্চিমবঙ্গের জলবায়ু এবং ঋতু অনুযায়ী সবজি বেছে নিন। ২০২৫ সালের জন্য প্রস্তাবিত সবজির মধ্যে রয়েছে পালং শাক, বেগুন, টমেটো, গাজর, মরিচ, ফুলকপি, এবং বাঁধাকপি।
খরা-সহনশীল এবং দেশীয় জাত যেমন দেশী ধানের জাত বা জৈব বীজ ব্যবহার করুন।
কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র (KVK) থেকে জৈব বীজ সংগ্রহ করুন। - জৈব সার ও কীটনাশক ব্যবহার:
জৈব সার যেমন ভার্মিকম্পোস্ট, গোবর সার, এবং বায়ো-ফার্টিলাইজার (Rhizobium, Azotobacter) ব্যবহার করুন।
জৈব কীটনাশক হিসেবে নিম তেল বা জৈব পদ্ধতি ব্যবহার করুন।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের স্কিম যেমন RKVY এবং PKVY-এর মাধ্যমে জৈব সারের জন্য সাবসিডি পাওয়া যায়। - জৈব সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া:
জৈব পণ্যের গুণমান নিশ্চিত করতে সার্টিফিকেশন প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গে, Participatory Guarantee System (PGS-India) সার্টিফিকেশন ছোট ও মাঝারি কৃষকদের জন্য সাশ্রয়ী।
PGS-India-এর জন্য pgsindia-ncof.gov.in-এ রেজিস্ট্রেশন করুন অথবা APEDA-এর মাধ্যমে তৃতীয় পক্ষের সার্টিফিকেশন নিন।
সার্টিফিকেশন পণ্যের গুণমান নিশ্চিত করে এবং রপ্তানি বাজারে প্রিমিয়াম মূল্য পেতে সহায়তা করে।

সরকারি স্কিম ও সহায়তা:
- পরম্পরাগত কৃষি বিকাশ যোজনা (PKVY): এই স্কিমের মাধ্যমে জৈব ইনপুট, প্রশিক্ষণ এবং সার্টিফিকেশনের জন্য আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়।
- রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা (RKVY): জৈব কৃষির জন্য প্রশিক্ষণ, বীজ এবং সরঞ্জামের জন্য সাবসিডি প্রদান করে।
- ন্যাশনাল মিশন অন অয়েলসিডস অ্যান্ড অয়েল পাম (NMOOP): জৈব সার এবং বায়ো-ফার্টিলাইজারের জন্য হেক্টর প্রতি ৩০০ টাকা সাবসিডি।
- পশ্চিমবঙ্গ সরকার উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া এবং হুগলি জেলায় ৩২টি জৈব গ্রাম এবং ১২০টি ৫০ একরের ক্লাস্টার গঠন করেছে।
- স্বনির্ভর কৃষি প্রকল্প: এই প্রকল্পের মাধ্যমে বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতায় জৈব কৃষি প্রচার করা হচ্ছে।
প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা:
- কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র (KVK) এবং পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কৃষি বিপণন বোর্ড থেকে জৈব কৃষি প্রশিক্ষণ নিন।
- নিউ টাউন কলকাতা ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (NKDA) জৈব কৃষির জন্য গবেষণা এবং পরীক্ষাগার সুবিধা প্রদান করে।
- স্থানীয় এনজিও যেমন SwitchON Foundation জৈব কৃষির প্রশিক্ষণ ও সৌরশক্তি-চালিত কৃষি পদ্ধতি প্রচার করছে।
- বিপণন ও বাজারজাতকরণ:
- পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কৃষি বিপণন বোর্ড কৃষকদের জন্য কৃষক বাজার স্থাপন করেছে, যেখানে জৈব পণ্য বিক্রি করা যায়।
- নিউ টাউনে ‘জৈব হাট’ নামে একটি জৈব বাজার স্থাপিত হয়েছে।
- TONA Organic Farm-এর মতো সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে জৈব পণ্য বিক্রির সুযোগ পাওয়া যায়।
পশ্চিমবঙ্গে জৈব সবজি চাষের সুবিধা
- উচ্চ চাহিদা: শহরাঞ্চলে জৈব সবজির চাহিদা ক্রমবর্ধমান, যা কৃষকদের জন্য লাভজনক। উদাহরণস্বরূপ, এক একর জৈব টমেটো চাষ থেকে ৩,০০,০০০ টাকা আয় সম্ভব।
- মাটির স্বাস্থ্য: জৈব কৃষি মাটির উর্বরতা বাড়ায় এবং রাসায়নিক দূষণ কমায়।
- সরকারি সহায়তা: সরকারি স্কিম যেমন PKVY এবং RKVY কৃষকদের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করে।
- পরিবেশগত স্থায়িত্ব: জৈব কৃষি জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়ক এবং টেকসই কৃষি প্রচার করে।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
চ্যালেঞ্জ: জৈব সার্টিফিকেশনের খরচ, বীজের প্রাপ্যতা, এবং কৃষকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব।
সমাধান: PGS-India-এর মাধ্যমে সাশ্রয়ী সার্টিফিকেশন, KVK থেকে বীজ সংগ্রহ, এবং সরকারি প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ।
সরকারি নির্দেশিকা ২০২৫
পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০২৫ সালে জৈব কৃষি প্রচারে নিম্নলিখিত নির্দেশিকা জারি করেছে:
- জৈব গ্রাম গঠন: উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া এবং হুগলিতে ৩২টি জৈব গ্রাম এবং ১২০টি ক্লাস্টার গঠন।
- গ্রিনহাউস ও প্যাক হাউস: সরকার জৈব কৃষকদের জন্য গ্রিনহাউস এবং প্যাক হাউস সরবরাহ করছে।
- জৈব বাজার: নিউ টাউনে ‘জৈব হাট’ এবং কৃষক বাজারের মাধ্যমে পণ্য বিক্রির সুবিধা।
- জৈব মাছ চাষ: মালদা জেলায় শুরু হওয়া জৈব মাছ চাষ প্রকল্প, যা ধানের সঙ্গে সমন্বিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গে জৈব সবজি চাষ একটি লাভজনক এবং টেকসই কৃষি পদ্ধতি, যা কৃষকদের আয় বাড়ানোর পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায় সহায়ক। ২০২৫ সালে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নির্দেশিকা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের স্কিম যেমন PKVY, RKVY, এবং NMOOP কৃষকদের জন্য আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করছে। জমি নির্বাচন, জৈব বীজ ও সার ব্যবহার, সার্টিফিকেশন এবং সরকারি সুবিধার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকরা জৈব সবজি চাষে সফল হতে পারেন। এই পদ্ধতি কেবল কৃষকদের জীবিকা উন্নত করবে না, বরং পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাতকে টেকসই ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে।