দার্জিলিং জেলার (Darjeeling) রাজনৈতিক মঞ্চে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। পাহাড়ের এই জেলায় হঠাৎ করেই শতাধিক তৃণমূল কর্মী ও সমর্থক ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বা সিপিআইএম-এ যোগ দিয়েছেন। এই ঘটনা উত্তরবঙ্গের রাজনীতিতে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছে। জেলা সিপিআইএম নেতৃত্বের দাবি, তৃণমূল কংগ্রেসে ভাঙনের স্রোত শুরু হয়েছে, এবং আগামী ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই প্রবণতা আরও তীব্র হবে।
দার্জিলিংয়ে তৃণমূলের ভাঙন
দার্জিলিং জেলা সিপিআইএম নেতৃত্ব জানিয়েছে, ফুলবাড়ি-ডাবগ্রামের ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের আশরফ নগর এলাকা থেকে বহু পরিবার তৃণমূল কংগ্রেস ত্যাগ করে বাম শিবিরে যোগ দিয়েছেন। শুক্রবার ডাবগ্রামের তিন নম্বর এরিয়া দপ্তরে একটি যোগদান কর্মসূচির আয়োজন করা হয়, যেখানে জেলা সিপিআইএম সম্পাদক সমন পাঠকসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এই কর্মসূচিতে প্রায় শতাধিক তৃণমূল কর্মী ও সমর্থক সিপিআইএম-এর পতাকা হাতে তুলে নিয়েছেন। এই ঘটনা তৃণমূলের জন্য একটি বড় ধাক্কা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, বিশেষ করে পাহাড়ি জেলায় যেখানে দলটি ইতিমধ্যেই গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা (জিজেএম) এবং ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চার (বিজিপিএম) মতো আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি।
তৃণমূলের এই ভাঙনের পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, দার্জিলিংয়ে গোর্খাল্যান্ডের দাবি এবং স্থানীয় সমস্যা, যেমন চা বাগান শ্রমিকদের দুর্দশা এবং পর্যটন শিল্পের অব্যবস্থাপনা, নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়ছে। ২০১৯ সাল থেকে দার্জিলিং লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি প্রভাব বজায় রাখলেও, তৃণমূলের প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতা এবং স্থানীয় নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ কোন্দল কর্মীদের মধ্যে হতাশা তৈরি করেছে। সিপিআইএম নেতা সমন পাঠক দাবি করেছেন, “তৃণমূলের দুর্নীতি এবং জনবিচ্ছিন্ন নীতির কারণে সাধারণ মানুষ এখন বিকল্প খুঁজছেন। আমরা সেই বিকল্প হিসেবে জনগণের পাশে থাকব।”
বাম শিবিরের উত্থান
দার্জিলিংয়ে সিপিআইএম-এর এই যোগদান কর্মসূচি বাম শিবিরের পুনরুত্থানের ইঙ্গিত দিচ্ছে। গত বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচনে বাম দলগুলি কোনও আসন জিততে না পারলেও, পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষ করে, দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়িতে সিপিআইএম-এর সংগঠন শক্তিশালী করার জন্য নতুন নেতৃত্ব গঠন করা হয়েছে। সম্প্রতি, সিপিআইএম দার্জিলিং জেলায় একটি নয় সদস্যের সেক্রেটারিয়েট গঠন করেছে, যার মধ্যে একজন মহিলা সদস্যও রয়েছেন। এই পদক্ষেপ জেলায় দলের সাংগঠনিক কাঠামোকে আরও মজবুত করার লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে।
সিপিআইএম নেতা মোহাম্মদ সেলিম দাবি করেছেন, তৃণমূল এবং বিজেপি উভয় দলই জনগণের মৌলিক চাহিদা উপেক্ষা করে ধর্মীয় ভাবাবেগকে ভোটের জন্য ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, “দার্জিলিংয়ে মানুষ এখন বুঝতে পারছেন যে তৃণমূল এবং বিজেপি একই ধরনের নীতি অনুসরণ করে। আমরা তাদের জন্য একটি বিকল্প পথ দেখাব।” সেলিমের এই মন্তব্য ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে বাম শিবিরের কৌশলগত পরিকল্পনার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
দার্জিলিংয়ের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি সবসময়ই জটিল। গোর্খাল্যান্ডের দাবি এবং পাহাড়ি জনগণের স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষা এখানকার রাজনীতির মূল বিষয়। তৃণমূল কংগ্রেস গোর্খাল্যান্ডের দাবির বিরোধিতা করে আসছে, যেখানে বিজেপি এই ইস্যুতে কৌশলগতভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনবার লোকসভা নির্বাচনে জয়ী হয়েছে। তবে, বিজেপির প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতা এবং তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল জনগণের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতিতে, সিপিআইএম তৃণমূল এবং বিজেপি-বিরোধী জোট গঠনের চেষ্টা করছে, যা ২০২৬ সালের নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
শুক্রবার পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুরে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী রাজ্যে সরকার পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “বাংলার জনগণ এখন পরিবর্তন চায়। তৃণমূলের দুর্নীতি এবং অপশাসন থেকে মুক্তি পেতে হবে।” তবে, তৃণমূল নেতৃত্ব দাবি করেছে, রাজ্যবাসী বিজেপির ‘বাঙালি-বিরোধী’ নীতির বিরুদ্ধে সরব হবেন এবং মোদীর আহ্বানে সাড়া দেবেন না। এই রাজনৈতিক দড়ি টানাটানির মধ্যে দার্জিলিংয়ে তৃণমূল ত্যাগীদের সিপিআইএম-এ যোগদান একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
সম্ভাব্য প্রভাব
দার্জিলিংয়ে তৃণমূলের এই ভাঙন বাম শিবিরের জন্য একটি সুযোগ তৈরি করেছে। গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোট উত্তরবঙ্গে কিছু এলাকায় প্রভাব ফেলেছিল। বিশেষ করে, দার্জিলিং এবং জলপাইগুড়ির মতো জেলাগুলিতে বাম দলগুলি তাদের পুরনো ভোট ব্যাঙ্ক পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে। ২০২২ সালে দার্জিলিংয়ে সিপিআইএম থেকে ছয়জন নেতা সিপিআই-তে যোগ দিলেও, বর্তমানে সিপিআইএম তাদের সাংগঠনিক কাঠামো শক্তিশালী করছে।
অন্যদিকে, বিজেপির শিবিরেও ধস নামছে। গোর্খাল্যান্ড ইস্যুতে বিজেপির প্রতিশ্রুতি পূরণে ব্যর্থতা এবং স্থানীয় নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ সমস্যা দার্জিলিংয়ে দলের অবস্থানকে দুর্বল করেছে। সিপিআইএম নেতৃত্ব আশা করছে, তৃণমূল এবং বিজেপি থেকে হতাশ ভোটাররা তাদের দিকে ঝুঁকবে। সমন পাঠক বলেন, “আমরা দার্জিলিংয়ে জনগণের সমস্যা নিয়ে কাজ করছি। চা বাগান শ্রমিকদের দুর্দশা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি, এবং পর্যটন শিল্পের অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চলবে।”
দার্জিলিংয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের শতাধিক কর্মী-সমর্থকের সিপিআইএম-এ যোগদান ২০২৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে উত্তরবঙ্গের রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ তৈরি করতে পারে। তৃণমূলের দুর্নীতি এবং বিজেপির প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের কারণে জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বাড়ছে, যা বাম শিবিরের জন্য সুযোগ তৈরি করেছে। সিপিআইএম-এর সাংগঠনিক পুনর্গঠন এবং তৃণমূল ত্যাগীদের যোগদান দার্জিলিংয়ে বামেদের প্রভাব বাড়াতে পারে। আগামী দিনে এই রাজনৈতিক গতিবিধি কীভাবে পাহাড়ের রাজনীতিকে প্রভাবিত করে, তা নিয়ে সকলের নজর থাকবে।