উত্তরবঙ্গে কৃষকদের জন্য বন্যা কেন একটি প্রধান সমস্যা হয়ে উঠেছে

উত্তরবঙ্গের কৃষকদের (North Bengal Farmers) জন্য বন্যা গত কয়েক বছরে একটি ভয়ঙ্কর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, এবং দার্জিলিং-এর মতো জেলাগুলিতে প্রতি বছর মৌসুমি…

North Bengal Farmers, Flood Damage Crops, Bengal Farming Challenges, North Bengal Floods, Agricultural Losses

উত্তরবঙ্গের কৃষকদের (North Bengal Farmers) জন্য বন্যা গত কয়েক বছরে একটি ভয়ঙ্কর সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, এবং দার্জিলিং-এর মতো জেলাগুলিতে প্রতি বছর মৌসুমি বৃষ্টি এবং নদীগুলির উপচে পড়া কৃষিজমি ধ্বংস করছে, ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করছে এবং কৃষকদের জীবিকার উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। তিস্তা, মহানন্দা, এবং জলঢাকার মতো নদীগুলির আকস্মিক বন্যা এবং হিমালয়ের পাদদেশ থেকে আসা অতিরিক্তর প্রবাহ উত্তরবঙ্গের কৃষিকে একটি সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এই প্রতিবেদনে আমরা বন্যার কারণে কৃষকদের মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জ, ফসলের ক্ষতি, এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।

বন্যার কারণ এবং প্রভাব
উত্তরবঙ্গে বন্যার প্রধান কারণ হল প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট উভয় কারণের সমন্বয়। প্রথমত, হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত উত্তরবঙ্গ ভৌগোলিকভাবে বন্যাপ্রবণ। তিস্তা নদীর মতো নদীগুলি সিকিম এবং ভুটান থেকে প্রচুর পরিমাণে পলি এবং বহন করে, যা বর্ষাকালে নদীর তীর ভেঙে বন্যার সৃষ্টি করে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে তিস্তা নদীর বন্যা জলপাইগুড়ির গাজলডোবা অঞ্চলে প্রায় ২০২ হেক্টর কৃষিজমি ধ্বংস করে, যেখানে পলির স্তর ৪-৫ ফুট পুরু হয়ে জমি অকেজো করে দেয়। এই ঘটনায় কৃষক গোপাল সরকারের মতো অনেকে তাদের ধান, আলু, এবং শাকসবজির ফসল হারিয়েছেন।

   

দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তন এই সমস্যাকে আরও জটিল করেছে। অপ্রত্যাশিত এবং তীব্র বৃষ্টিপাত, যা আগে বিরল ছিল, এখন নিয়মিত ঘটছে। ২০২৪ সালের প্রথম নয় মাসে, পশ্চিমবঙ্গ ৮৬% দিনে চরম আবহাওয়ার ঘটনার সম্মুখীন হয়েছে, যার ফলে ২,০০,৯০০ হেক্টর জমিতে ফসলের ক্ষতি হয়েছে। উত্তরবঙ্গে তিস্তা এবং কোশি নদীর মতো নদীগুলির উপরর প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষকরা ধান, আলু, মটরশুঁটি, এবং ফুলকপির মতো ফসল চাষ করতে অক্ষম হয়েছেন।

তৃতীয়ত, মানবসৃষ্ট কারণগুলিও এই সংকটে ভূমিকা রাখছে। সিকিমের তিস্তা বাঁধ এবং দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (ডিভিসি) থেকে অপরিকল্পিতভাবে ছাড়া বন্যার তীব্রতা বাড়িয়েছে। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে, ডিভিসি থেকে মাইথন এবং পানচেত বাঁধ থেকে ৬০,০০০ কিউসেক ছাড়ার ফলে দক্ষিণবঙ্গে বন্যা দেখা দেয়, যা উত্তরবঙ্গের কৃষকদেরও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করে। এছাড়া, হিমালয়ের পাদদেশে বন উজাড় এবং নদীর তীরে অবৈধ বালি খনন নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করছে, যা বন্যার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

কৃষকদের মুখোমুখি চ্যালেঞ্জ
বন্যার কারণে উত্তরবঙ্গের কৃষকরা একাধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন। প্রথমত, ফসলের ক্ষতি তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের তিস্তা বন্যায় গাজলডোবার ২০০ কৃষক তাদের জমি অকেজো হয়ে যাওয়ায় ফসল ফলাতে পারেননি। ধান, যা এই অঞ্চলের প্রধান ফসল,র নিচে ডুবে যাওয়ায় বা পলির স্তরে চাপা পড়ায় নষ্ট হয়ে গেছে। এই ক্ষতি কৃষকদের ঋণের বোঝা বাড়িয়েছে, কারণ অনেকে ফসল চাষের জন্য মাইক্রোফাইনান্স সংস্থা থেকে ঋণ নিয়েছিলেন।

দ্বিতীয়ত, মাটির উর্বরতা হ্রাস পাওয়া একটি বড় সমস্যা। বন্যার প্রচুর পরিমাণে পলি এবং বালি নিয়ে আসে, যা জমির উপরিভাগে জমা হয়ে উর্বরতা নষ্ট করে। গাজলডোবার কৃষক গোপাল সরকার জানিয়েছেন, তাঁর জমিতে ৪-৫ ফুট পুরু পলির স্তর জমা হয়েছে, যা কুমড়োর মতো ফসলের পুষ্টির ঘাটতি সৃষ্টি করছে। এই অবস্থায় ফসল ফলানোর জন্য অতিরিক্ত সার এবং শ্রমের প্রয়োজন, যা কৃষকদের খরচ বাড়ায়।

Advertisements

তৃতীয়ত, বন্যার পরে কৃষকদের জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ বা সরকারি সহায়তার অভাব একটি গুরুতর সমস্যা। যদিও পশ্চিমবঙ্গ সরকার ফসল বীমার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, অনেক কৃষক অভিযোগ করেছেন যে ত্রাণ সামগ্রী এবং আর্থিক সহায়তা সীমিত বা নির্বাচিত গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ, আমতার এক কৃষক জানিয়েছেন, তিনি সরকারি ত্রাণ হিসেবে কিছুই পাননি, যদিও তাঁর তিন বিঘা ধানের জমি বন্যায় ধ্বংস হয়েছে।

সমাধানের পথ
বন্যার প্রভাব কমাতে এবং উত্তরবঙ্গের কৃষকদের সুরক্ষা দিতে কিছু সমাধান গ্রহণ করা যেতে পারে। প্রথমত, ফ্লাডপ্লেন জোনিং আইন কার্যকর করা প্রয়োজন। কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রণালয় পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে বন্যাপ্রবণ নদী অঞ্চলে জোনিং বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছে, যা বন্যার ক্ষতি সীমিত করতে পারে। দ্বিতীয়ত, বন্যা-প্রতিরোধী ফসলের জাত যেমন জলাবদ্ধতা-সহনশীল ধানের জাত বা শাকসবজি চাষের প্রচার করা উচিত। বাংলাদেশের মতো দেশে কৃষকরা ভাসমান কৃষি (ফ্লোটিং ফার্মিং) পদ্ধতি গ্রহণ করেছে, যা উত্তরবঙ্গের জলাবদ্ধ অঞ্চলে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

তৃতীয়ত, ড্রেনেজ এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নতি জরুরি। নদীর তীরে অবৈধ বালি খনন রোধ করা এবং প্রাকৃতিক জলাশয় ও হ্রদগুলির সংযোগ পুনরুদ্ধার করা বন্যার নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। এছাড়া, কৃষকদের জন্য বীমা এবং ত্রাণ ব্যবস্থা আরও স্বচ্ছ ও অ্যাক্সেসযোগ্য করা দরকার। সরকারি স্তরে কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং জলবায়ু-সহনশীল কৃষি পদ্ধতির প্রচারও ক্ষতি কমাতে পারে।

উত্তরবঙ্গের কৃষকদের জন্য বন্যা শুধু একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং এটি তাদের জীবিকা ও অর্থনীতির উপর একটি গভীর সংকট। জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নিষ্কাশন, এবং অপর্যাপ্ত সরকারি সহায়তা এই সমস্যাকে আরও জটিল করেছে। তবে, সঠিক পরিকল্পনা, বন্যা-প্রতিরোধী কৃষি, এবং সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। উত্তরবঙ্গের কৃষকদের তাদের জমি ও জীবিকা রক্ষার জন্য সমন্বিত প্রচেষ্টা এবং দীর্ঘমেয়াদী সমাধান প্রয়োজন।