উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় টম্যাটো ও আলুর দাম পড়ে যাওয়ায় বহু কৃষক সম্প্রতি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছিলেন। মাঠের ফসল ঠিকঠাক ফললেও বাজারে তার ন্যায্য দাম না মেলায় হতাশ হয়ে পড়েছিলেন চাষিরা। সেই সময় কৃষিদপ্তরের তরফ থেকে একটি বিকল্প পথ দেখানো হয়েছিল—উচ্ছে চাষ। যদিও প্রাথমিকভাবে অধিকাংশ কৃষক সেই পরামর্শকে বিশেষ গুরুত্ব দেননি। বরং বর্ষার পর ধান ঘরে তোলার পর তাঁরা আবার পরিচিত ও প্রচলিত ফসলের দিকেই ঝুঁকেছিলেন—যেমন আলু, ভুট্টা কিংবা টম্যাটো।
কিন্তু এ বছরের বাজারচিত্র ভিন্ন। চাহিদার তুলনায় জোগান বেড়ে যাওয়ায় আলু ও টম্যাটোর দাম আশানুরূপ ওঠেনি। উলটে খরচের টাকা তোলাই মুশকিল হয়ে পড়েছে অনেকের পক্ষে। কৃষকদের একাংশ যখন এই লোকসানে জর্জরিত, তখনই ভিন্ন ছবি দেখা যাচ্ছে সেই সব খেতগুলোতে, যেখানে চাষিরা কৃষিদপ্তরের পরামর্শ মেনে উচ্ছে চাষ করেছিলেন।
উচ্ছে সাধারণত হাতির অপছন্দের একটি ফসল। উত্তরবঙ্গের আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, দার্জিলিং ও কালিম্পং জেলাগুলিতে হাতির উপদ্রব নিত্যদিনের সমস্যা। সেই কারণেই কৃষিদপ্তর দীর্ঘদিন ধরেই বলছিল, হাতির উপদ্রবপ্রবণ এলাকায় উচ্ছে চাষে কৃষকের লাভ যেমন হবে, তেমনই ফসলও থাকবে নিরাপদ। তবুও অনেকেই সন্দিহান ছিলেন। কিন্তু এবার বাস্তব পরিস্থিতি প্রমাণ করল, কৃষিদপ্তরের সেই পরামর্শ কতটা কার্যকর।
যে কৃষকেরা উচ্ছে চাষে ঝুঁকেছিলেন, তাঁদের আজ মুখে হাসি। উচ্ছে শুধু স্থানীয় বাজারেই নয়, খেত থেকে সরাসরি পাঠানো হচ্ছে ভিন রাজ্যে—বিশেষ করে রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ এবং দিল্লিতে। দূরবর্তী রাজ্যের পাইকারি ব্যবসায়ীরা সরাসরি কৃষকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আগাম ফসল বুকিং করছেন। ফলে বাজারে গিয়ে দাম নিয়ে দরাদরি করতে হচ্ছে না, ফলে সময় ও পরিশ্রম দুই-ই বাঁচছে। কৃষকেরা ফসল তুলেই পাচ্ছেন নগদ টাকা, যা তাঁদের চাষে নতুন উদ্যম এনে দিয়েছে।
জলপাইগুড়ির এক চাষি মদন রায় বললেন, “বছর দুয়েক আগে কৃষিদপ্তরের লোক এসে বলেছিলেন, উচ্ছে চাষ করলে লাভ হবে আর হাতিও আসবে না। তখন শুনিনি। এবার আলুতে বিশাল ক্ষতি হওয়ার পর ভাবলাম, একবার চেষ্টা করে দেখি। এখন তো মনে হচ্ছে আরও আগে শুরু করা উচিত ছিল। এত চাহিদা আছে, ভাবতেও পারিনি।”
একই অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন কোচবিহারের বক্সিরহাট এলাকার চাষি বাসুদেব পাল। তিনি বললেন, “টম্যাটোতে গতবার খুব ভাল দাম পেয়েছিলাম। ভাবলাম এবারও তা-ই হবে। কিন্তু বাজারে দাম পড়ে গেল। উচ্ছে করেছি এক বিঘা জমিতে, সেটাই এখন আমাদের সংসারের রক্ষাকবচ।”
উচ্ছে চাষে খরচ তুলনায় কম, আর পরিশ্রমও অপেক্ষাকৃত কম। ফসল ওঠার সময়ও দ্রুত, ফলে এক মরশুমে একাধিক বার উচ্ছে ফলানো সম্ভব। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বাজারের চাহিদা এবং দীর্ঘমেয়াদি রপ্তানির সুযোগ। কৃষিদপ্তরও এখন উচ্ছে চাষে আরও বেশি কৃষককে উৎসাহিত করছে। প্রশিক্ষণ, বীজ, সার এবং আধুনিক কৃষি পদ্ধতির মাধ্যমে চাষিদের পাশে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সার্বিকভাবে বলাই যায়, উত্তরবঙ্গের কৃষিক্ষেত্রে এক নতুন সম্ভাবনার নাম হয়ে উঠছে উচ্ছে। চাষিদের অভিজ্ঞতা এবং বাজারের প্রতিক্রিয়া মিলিয়ে ভবিষ্যতে আরও বড় পরিসরে এই চাষ ছড়িয়ে পড়বে বলেই আশাবাদী বিশেষজ্ঞরা। আর কৃষকেরাও এবার বুঝতে পেরেছেন—সঠিক পরামর্শ মানলে ফল যে কতটা মিষ্টি হতে পারে, তা উচ্ছে চাষেই প্রমাণিত।