ভারতীয় পুঁজিবাজারে অতিমাত্রায় স্বল্পমেয়াদি ডেরিভেটিভস লেনদেনের ক্রমবর্ধমান প্রবণতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করল বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অফ ইন্ডিয়া (SEBI)। বৃহস্পতিবার কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি (CII) আয়োজিত ১১তম ক্যাপিটাল মার্কেটস কনক্লেভে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সেবির হোলটাইম সদস্য অনন্ত নারায়ণ বলেন, “এই ধরনের অস্বাভাবিক ভারসাম্য পুঁজিবাজারের স্বাস্থ্যকে বিঘ্নিত করতে পারে।”
৯১ শতাংশ ব্যক্তি লগ্নিকারী ক্ষতির মুখে:
নারায়ণ বলেন, “সেবির নিজস্ব গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৪-২৫ আর্থিক বছরে ফিউচারস এবং অপশনস (F&O) লেনদেনে ৯১ শতাংশ ব্যক্তি লগ্নিকারী নেট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। তাঁদের সম্মিলিত ক্ষতির পরিমাণ ১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি, যা কার্যত দেশের মূলধন গঠনের সুযোগ হারিয়ে যাচ্ছে।”
তিনি উল্লেখ করেন, অধিকাংশ ডেরিভেটিভস লেনদেনই এক্সপায়ারি ডে-র ইন্ডেক্স অপশন ট্রেডের মধ্যে সীমাবদ্ধ, যা প্রায়ই ক্যাশ মার্কেটের তুলনায় ৩৫০ গুণ বেশি হয়ে থাকে। এই ধরনের ট্রেডিং মূলধন গঠনে খুব একটা অবদান রাখে না, বরং বাজারের অস্থিরতা বাড়ায়।
দীর্ঘমেয়াদি পণ্যের প্রতি গুরুত্ব:
অনন্ত নারায়ণ বলেন, “আমরা ক্যাশ ইকুইটি মার্কেটকে গভীরতর করার পাশাপাশি ডেরিভেটিভস পণ্যের মেয়াদ ও গুণমান বাড়ানোর পথ খুঁজছি। স্বল্পমেয়াদি পণ্যের পরিবর্তে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান দিকেই আমাদের মনোনিবেশ করা উচিত।”
তিনি জানান, ইতিমধ্যেই অক্টোবর ২০২৪ এবং মে ২০২৫-এ কিছু নিয়ন্ত্রক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা এই অতি-সক্রিয়তা কিছুটা কমাতে সাহায্য করছে। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, “এই ধারা বজায় রাখতে হলে বিনিয়োগকারী, এক্সচেঞ্জ, ব্রোকার ও অন্যান্য অংশীদারদের গঠনমূলক ভূমিকা নিতে হবে।”
‘এই প্রবণতা টেকসই কি না’ প্রশ্ন সেবির:
নারায়ণ বলেন, “এক্সচেঞ্জ ও ব্রোকারদের রাজস্বের বড় অংশ এই স্বল্পমেয়াদি ট্রেডিং থেকে এলেও প্রশ্ন হচ্ছে, এটি আদৌ কি টেকসই?”
সাবধানবাণী উচ্চারণ করে তিনি বলেন, যদি বাজারে অনিয়ন্ত্রিত জল্পনা-কল্পনা, প্রযুক্তিগত ব্যর্থতা, দুর্বল গভর্ন্যান্স বা ডিজাইন ত্রুটি থাকে, তবে তা লগ্নিকারীদের আস্থায় চরম আঘাত হানতে পারে। তিনি একে ‘সোনার ডিম পাড়া হাঁসকে মেরে ফেলার মতো’ অবস্থা বলে অভিহিত করেন।
ভারসাম্য বজায় রাখার তাগিদ:
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করলেও বৈধ ব্যবসা ও মূলধন গঠন বাধা পেতে পারে। এই দুই বিপদের মাঝে ভারসাম্য রেখে কাজ করাই সেবির লক্ষ্য। “আমরা উভয় ঝুঁকি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করি এবং বিস্তৃত পরামর্শের মাধ্যমে ন্যূনতম ভুলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করি,” বলেন নারায়ণ।
তালিকাভুক্তির সুবিধা ও MSME-দের উৎসাহ:
অনন্ত নারায়ণ আরও বলেন, “বর্তমানে বাজারে মূল্যায়ন অত্যন্ত আকর্ষণীয়। এই সময় যদি কোনো সংস্থা তালিকাভুক্ত হয়, তবে তা মূলধন সংগ্রহে এবং বড় হওয়ার পথে ‘ফোর্স মাল্টিপ্লায়ার’ হিসেবে কাজ করতে পারে।”
তিনি আশা প্রকাশ করেন, আরও বেশি ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি শিল্প (MSME) তালিকাভুক্ত হয়ে আগামী দিনে বড়ো জাতীয় সংস্থায় পরিণত হবে। তবে তিনি এটিও বলেন, “তালিকাভুক্তির সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে প্রোমোটারদের হাতে।”
অন্যান্য ক্ষেত্রেও উদ্ভাবনের উদ্যোগ:
SEBI কর্পোরেট বন্ড, ইনভিট (InvITs), রেইট (REITs), মিউনিসিপাল বন্ড এবং কমোডিটি ডেরিভেটিভস-এর মতো বিভিন্ন অ্যাসেট ক্লাসে স্বচ্ছতা ও উদ্ভাবন বাড়ানোর দিকেও নজর দিচ্ছে।
‘বিশ্বাস’ – সুস্থ বাজারের মূলমন্ত্র:
নারায়ণ বলেন, “স্বচ্ছতা হল সর্বোত্তম জীবাণুনাশক। তালিকাভুক্ত সংস্থার জন্য প্রকাশ ও গভর্ন্যান্স সংক্রান্ত নিয়মকানুন মানা দীর্ঘমেয়াদে সংস্থার টেকসই বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করে।”
শেষে তিনি স্টক এক্সচেঞ্জ, ক্লিয়ারিং কর্পোরেশন ও ডিপোজিটরিগুলির প্রতি আহ্বান জানান যাতে তারা ‘অপারেশনাল রেজিলিয়েন্স’ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় আরও গুরুত্ব দেয় এবং বাণিজ্যিক স্বার্থ ও জনআস্থার মাঝে ভারসাম্য বজায় রাখে।
একই সঙ্গে তিনি ব্রোকার ও অন্যান্য মধ্যস্থতাকারীদের উদ্দেশে বলেন, “আপনারা বিশ্বাসযোগ্য পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করুন। কিছু ভুল দেখলে সেটি বলুন, আর নিয়ন্ত্রক ছাড় চাইলে বলুন কীভাবে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করবেন।”
ভারতীয় পুঁজিবাজারে যখন অব্যাহত বিনিয়োগের ধারা, তখন স্বচ্ছতা, দায়িত্বশীলতা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ওপর জোর দিল সেবি। আজকের বার্তায় মূল সুর – বাজার বড় হোক, কিন্তু স্থিতিশীলতার সঙ্গে।