ভুট্টা চাষে বিপ্লব ঘটাতে চলেছে বাংলা

পশ্চিমবঙ্গে কৃষি ক্ষেত্রে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা হতে চলেছে। রাজ্য সরকার ভুট্টা চাষের (Maize Farming) পরিধি ৬০,০০০ হেক্টর বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা নিয়েছে, যা রাজ্যের ক্রমবর্ধমান…

West Bengal Set to Revolutionize Maize Farming with Ambitious Expansion Plan

পশ্চিমবঙ্গে কৃষি ক্ষেত্রে এক নতুন বিপ্লবের সূচনা হতে চলেছে। রাজ্য সরকার ভুট্টা চাষের (Maize Farming) পরিধি ৬০,০০০ হেক্টর বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা নিয়েছে, যা রাজ্যের ক্রমবর্ধমান পোলট্রি ও মৎস্য চাষের জন্য প্রয়োজনীয় পশুখাদ্যের চাহিদা মেটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে ১.৪৮ লক্ষ হেক্টর জমিতে ভুট্টা চাষ হয়, যার মাধ্যমে প্রায় ৫.৫ লক্ষ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদিত হয়। তবে, রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনার (RKVY) অধীনে ‘মেইজ মিশন’-এর মাধ্যমে আগামী তিন বছরে এই উৎপাদন ৭.৫ লক্ষ মেট্রিক টনে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়েছে রাজ্য। এই উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের মোট ৫০ লক্ষ মেট্রিক টন পশুখাদ্যের চাহিদার ১৫ শতাংশ পূরণ করতে চায় পশ্চিমবঙ্গ।

কেন ভুট্টা চাষের উপর জোর?
পশ্চিমবঙ্গের পোলট্রি ও মৎস্য চাষ শিল্প দ্রুত বিকাশ লাভ করছে। এই শিল্পগুলির জন্য ভুট্টা একটি অপরিহার্য কাঁচামাল, যা পশু ও মাছের খাদ্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। দেশের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে ভুট্টার উৎপাদন তুলনামূলকভাবে কম। তবে, রাজ্যের মাটি ও জলবায়ু ভুট্টা চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও কোচবিহারের মতো জেলাগুলিতে। এই অঞ্চলের মাটির গুণগত মান এবং জলবায়ু ভুট্টার ফলন বৃদ্ধির জন্য আদর্শ। রাজ্য সরকার এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে ভুট্টা চাষকে একটি লাভজনক এবং টেকসই কৃষি ব্যবস্থায় রূপান্তরিত করতে চায়।

   

হাইব্রিড বীজ ও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি
ভুট্টা চাষের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে রাজ্য সরকার হাইব্রিড বীজ ও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির উপর জোর দিচ্ছে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে প্রতি হেক্টরে ভুট্টার ফলন ৩.৭ টন, যা জাতীয় গড় ২.৭ টনের তুলনায় বেশি। তবে, এই ফলন আরও বাড়ানোর সম্ভাবনা রয়েছে। হাইব্রিড বীজ ব্যবহারের মাধ্যমে ফলন প্রতি হেক্টরে ৫ টন পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব বলে কৃষি বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এছাড়াও, সরকার কৃষকদের জন্য ভর্তুকিযুক্ত হাইব্রিড বীজ, সার এবং আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহ করছে। ড্রিপ ইরিগেশন, সঠিক সেচ ব্যবস্থা এবং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের জন্য জৈব পদ্ধতির প্রয়োগও কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় করা হচ্ছে।

উত্তরবঙ্গের ভূমিকা
উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি ভুট্টা চাষ বৃদ্ধির ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করবে। জলপাইগুড়ি ও আলিপুরদুয়ারের মতো জেলাগুলিতে মাটির উর্বরতা এবং জলবায়ু ভুট্টা চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। এই অঞ্চলে বছরে দুইবার ভুট্টা চাষ সম্ভব, যা কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। সরকার এই অঞ্চলের কৃষকদের প্রশিক্ষণ, বীজ সরবরাহ এবং বাজার সংযোগের মাধ্যমে উৎসাহিত করছে। এছাড়াও, দক্ষিণবঙ্গের কিছু জেলা যেমন পুরুলিয়া ও বাঁকুড়াতেও ভুট্টা চাষের সম্ভাবনা রয়েছে, যদিও এই অঞ্চলে সেচ ব্যবস্থার উন্নতি প্রয়োজন।

চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
ভুট্টা চাষ বৃদ্ধির পথে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অনেক কৃষক এখনও ধান চাষের প্রতি আকৃষ্ট, কারণ ধানের জন্য নিশ্চিত সংগ্রহ ব্যবস্থা রয়েছে। ভুট্টার ক্ষেত্রে বাজার সংযোগ এবং ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এই সমস্যা মোকাবেলায় সরকার কৃষকদের সঙ্গে পোলট্রি ও মৎস্য খাদ্য উৎপাদনকারী সংস্থাগুলির সরাসরি সংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়াও, সরকারি সংগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (MSP) নিশ্চিত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

Advertisements

কৃষকদের জন্য নতুন সম্ভাবনা
ভুট্টা চাষ কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক বিকল্প হতে পারে। ধানের তুলনায় ভুট্টা চাষে খরচ কম এবং ফলন বেশি। এছাড়াও, ভুট্টার চাহিদা শুধু পশুখাদ্যের জন্য নয়, শিল্প ক্ষেত্রেও রয়েছে। ভুট্টা থেকে স্টার্চ, তেল এবং অন্যান্য পণ্য তৈরি হয়, যা কৃষকদের আয়ের নতুন উৎস তৈরি করতে পারে। সরকারের এই উদ্যোগ কৃষকদের আর্থিক স্বাবলম্বিতা এবং রাজ্যের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী পাঁচ বছরে ভুট্টা চাষকে পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অর্থনীতির একটি প্রধান স্তম্ভ হিসেবে গড়ে তোলা হবে। এই লক্ষ্যে কৃষি বিশেষজ্ঞ, কৃষক ও শিল্পপতিদের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলিও এই উদ্যোগে অংশ নিচ্ছে। ভুট্টা চাষের এই বিপ্লব পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে এবং কৃষকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে।

এই উদ্যোগ শুধুমাত্র কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি নয়, বরং রাজ্যের খাদ্য নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার দিকে একটি বড় পদক্ষেপ। ভুট্টা চাষের এই নতুন যুগ পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য সমৃদ্ধির নতুন পথ প্রশস্ত করবে বলে আশা করা যায়।