ভারতের কৃষি খাত আবারও তার অসাধারণ স্থিতিস্থাপকতা প্রমাণ করেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের তৃতীয় ত্রৈমাসিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর ২০২৪), বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং বাণিজ্য প্রতিকূলতার মধ্যেও ভারতের কৃষিপণ্যের রফতানি (Agri Exports) ১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৩.১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। নীতি আয়োগের সাম্প্রতিক ‘ট্রেড ওয়াচ কোয়ার্টারলি’ প্রতিবেদন অনুসারে, এই বৃদ্ধির পিছনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে শস্য, বিশেষ করে ধান, এবং “শ্রী আন্না” নামে পরিচিত মিলেট। এই সাফল্য ভারতের কৃষি খাতের শক্তিশালী ভিত্তি এবং কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রমের প্রতিফলন।
ধানের রফতানি: বিশ্ব বাজারে ভারতের আধিপত্য
ধান ভারতের কৃষি রফতানির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ধানের রফতানি ১৩ শতাংশেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সময়ে ভারত বিশ্বের শীর্ষ ধান রফতানিকারক হিসেবে তার অবস্থান আরও মজবুত করেছে। ২০২৩-২৪ সালে ভারত ১৬.৫ মিলিয়ন মেট্রিক টন ধান রফতানি করেছে, যা বিশ্ব বাজারে তার শক্তিশালী উপস্থিতি প্রমাণ করে। এই সাফল্যের পিছনে রয়েছে উন্নত কৃষি প্রযুক্তি, কৃষকদের দক্ষতা এবং সরকারের নীতিগত সমর্থন।
Also Read | হাই পারফরম্যান্স ইঞ্জিনে দাপাবে নতুন স্পোর্টি স্কুটার! ভারতে দাম কত?
অনুকূল মৌসুমী অবস্থা এবং প্রাথমিক বপনও এই বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ২০২৪ সালে মৌসুমী বৃষ্টি সময়মতো এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে হওয়ায় ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়াও, সরকারের বিভিন্ন প্রণোদনা এবং রফতানি সহায়তা কৃষকদের উৎপাদন বাড়াতে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে উৎসাহিত করেছে। তবে, কিছু অঞ্চলে বিলম্বিত বৃষ্টি এবং বাজারের গতিশীলতার কারণে সয়াবিনের চাষ কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। এটি কৃষি খাতে আরও নীতিগত হস্তক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত দেয়।
মিলেটের উত্থান: শ্রী আন্নার জয়যাত্রা
ধানের পাশাপাশি, মিলেট বা “শ্রী আন্না” ভারতের কৃষি রফতানির একটি নতুন তারকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০২৪ সালে মিলেটের বপন ক্ষেত্রফল ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা এই ফসলের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এবং বাজারের চাহিদার প্রতিফলন। মিলেট শুধুমাত্র পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে গৃহীত হচ্ছে না, বরং এটি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতার জন্যও কৃষকদের কাছে পছন্দের ফসল হয়ে উঠেছে।
সরকারের ‘মিলেট মিশন’ এবং বিভিন্ন প্রচারমূলক কার্যক্রম মিলেটের চাষ ও রফতানি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মিলেটের চাহিদা বাড়ছে, এবং ভারত এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে নিজের অবস্থান শক্তিশালী করছে।
বাণিজ্য ভারসাম্য এবং পরিষেবা খাতের অবদান
ভারতের সামগ্রিক বাণিজ্য কর্মক্ষমতাও এই ত্রৈমাসিকে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে। নীতি আয়োগের প্রতিবেদন অনুসারে, ভারত ৫২.৩ বিলিয়ন ডলারের পরিষেবা বাণিজ্য উদ্বৃত্ত অর্জন করেছে, যা আইটি, পরামর্শ এবং গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) খাতের শক্তিশালী অবদানের ফল। এই উদ্বৃত্ত পণ্য বাণিজ্যের ক্রমবর্ধমান ঘাটতি পূরণে সহায়ক হয়েছে। কৃষি রফতানির সঙ্গে পরিষেবা খাতের এই সাফল্য ভারতের অর্থনীতির বৈচিত্র্য এবং শক্তি প্রদর্শন করে।
চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
যদিও কৃষি রফতানির এই বৃদ্ধি উৎসাহব্যঞ্জক, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা, জ্বালানি মূল্যের ওঠানামা এবং ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা ভবিষ্যতে রফতানির পথে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও, কিছু ফসল যেমন সয়াবিনের উৎপাদন হ্রাস কৃষকদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। তবে, সরকারের কৃষি-বান্ধব নীতি, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
Also Read | বাজার থেকে নিনজা-র এই বাইক তুলে নিচ্ছে কাওয়াসাকি, নেপথ্যে কারণ কী?
ভবিষ্যতে, ভারতের কৃষি রফতানি আরও বৈচিত্র্যময় করার সুযোগ রয়েছে। জৈব কৃষি, মূল্য সংযোজন পণ্য এবং টেকসই চাষ পদ্ধতির উপর জোর দিয়ে ভারত বিশ্ব বাজারে আরও শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারে। এছাড়াও, মিলেটের মতো পুষ্টিকর এবং জলবায়ু-বান্ধব ফসলের প্রচার বিশ্বব্যাপী চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে।
ভারতের কৃষি খাত আন্তর্জাতিক প্রতিকূলতার মাঝেও তার শক্তি এবং সম্ভাবনা প্রমাণ করেছে। ধান এবং মিলেটের রফতানি বৃদ্ধি, সরকারের নীতিগত সমর্থন এবং কৃষকদের অক্লান্ত পরিশ্রম এই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি। পরিষেবা খাতের শক্তিশালী অবদানের সঙ্গে মিলে ভারতের অর্থনীতি বিশ্ব মঞ্চে একটি শক্তিশালী খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। তবে, ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কৃষি খাতে আরও বিনিয়োগ, গবেষণা এবং নীতিগত সংস্কারের প্রয়োজন। ভারতের কৃষি খাতের এই জয়যাত্রা কেবল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই নয়, বরং কৃষকদের জীবনমান উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি।