রিয়েল ভয়েসেস! কৃষকরা নতুন রাজ্য কৃষি নীতি থেকে কী চান?

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অর্থনীতি রাজ্যের জনজীবনের মেরুদণ্ড। এই রাজ্যের প্রায় ৮০ লক্ষ কৃষক এবং কৃষি শ্রমিক কৃষি ও সম্পর্কিত কার্যকলাপের উপর নির্ভরশীল। তবে, জলবায়ু পরিবর্তন, মাটির…

Farmers Demand Sustainable, Inclusive New State Agricultural Policy for Bengal

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অর্থনীতি রাজ্যের জনজীবনের মেরুদণ্ড। এই রাজ্যের প্রায় ৮০ লক্ষ কৃষক এবং কৃষি শ্রমিক কৃষি ও সম্পর্কিত কার্যকলাপের উপর নির্ভরশীল। তবে, জলবায়ু পরিবর্তন, মাটির উর্বরতা হ্রাস, বাজারের অস্থিরতা, এবং ক্রমবর্ধমান উৎপাদন খরচের মতো চ্যালেঞ্জের মুখে কৃষকরা একটি শক্তিশালী, টেকসই, এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজ্য কৃষি নীতির (State Agricultural Policy) দাবি জানাচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গের কৃষক সংগঠনগুলি এবং সাধারণ কৃষকদের কণ্ঠস্বর একটি নতুন কৃষি নীতির জন্য আওয়াজ তুলছে, যা তাদের আয় বাড়াবে, পরিবেশ রক্ষা করবে, এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কৃষিকে টেকসই করবে। এই প্রতিবেদনে আমরা কৃষকদের প্রকৃত দাবিগুলি তুলে ধরছি।
কৃষকদের প্রধান দাবি

১. ন্যূনতম সমর্থন মূল্যের (MSP) আইনি গ্যারান্টি
কৃষকদের মধ্যে সবচেয়ে জোরালো দাবি হল ন্যূনতম সমর্থন মূল্যের (MSP) আইনি গ্যারান্টি। পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা বলছেন, বাজারে ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় তারা প্রায়ই লোকসানের মুখে পড়েন। উদাহরণস্বরূপ, নদিয়ার কৃষক রমেশ মণ্ডল জানান, “ধানের দাম এত কম যে উৎপাদন খরচও ওঠে না। MSP-এর আইনি গ্যারান্টি থাকলে আমরা নিশ্চিতভাবে ফসল বিক্রি করতে পারতাম।” সম্প্রতি, সম্যুক্ত কিষান মোর্চা (SKM) পাঞ্জাবে কেন্দ্রের খসড়া কৃষি বিপণন নীতির বিরোধিতা করেছে, কারণ এতে MSP-এর কোনও উল্লেখ নেই। বাংলার কৃষকরাও একই ধরনের নীতি চান, যা তাদের ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করবে।

   

২. জৈব এবং টেকসই চাষের জন্য সরকারি সহায়তা
জলবায়ু পরিবর্তন এবং মাটির ক্ষয়ের কারণে কৃষকরা জৈব চাষ এবং টেকসই কৃষি পদ্ধতির দিকে ঝুঁকছেন। বাঁকুড়ার কৃষক সুধীর মাহাতো বলেন, “রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের দাম আকাশছোঁয়া। জৈব সার এবং প্রাকৃতিক কীটনাশকের জন্য সরকারি ভর্তুকি চাই।” কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি মিশ্র চাষের প্রচার করলেও, কৃষকরা বলছেন যে এই উদ্যোগগুলি গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছায় না। তারা চান সরকার জৈব চাষের জন্য প্রশিক্ষণ, বীজ, এবং সরঞ্জাম সরবরাহ করুক। এছাড়া, টেকসই চাষের জন্য কম সুদে ঋণ এবং বীমা সুবিধার দাবিও উঠছে।

৩. কৃষি ঋণ মুক্তি এবং সহজলভ্য ঋণ
পশ্চিমবঙ্গের ৯৬% কৃষক ছোট ও প্রান্তিক, এবং তাদের গড় জমির আয়তন মাত্র ০.৭৭ হেক্টর। এই কৃষকরা প্রায়ই ঋণের জালে আটকে পড়েন। মুর্শিদাবাদের কৃষক শেখ আমিনুল বলেন, “ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া কঠিন, আর স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিলে সুদের বোঝা আমাদের ভেঙে দেয়।” কৃষকরা রাজ্য সরকারের কাছে ঋণ মুক্তির দাবি জানাচ্ছেন এবং সহজ শর্তে কৃষি ঋণের ব্যবস্থা চান। USDA-র মতো প্রোগ্রাম, যেমন আমেরিকায় নতুন কৃষকদের জন্য ঋণ এবং বীমা সুবিধা দেওয়া হয়, তেমনি বাংলায়ও কৃষকদের জন্য সহজলভ্য ঋণ ব্যবস্থার দাবি উঠছে।

৪. বাজার সংস্কার এবং সরাসরি বাজার অ্যাক্সেস
কৃষকরা বাজারে মধ্যস্থতাকারীদের দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। পশ্চিমবঙ্গে কৃষক বাজার (Krishak Bazar) এবং ই-নাম (e-NAM) প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে কিছু অগ্রগতি হয়েছে, তবে এটি পর্যাপ্ত নয়। হুগলির কৃষক মিনতি মন্ডল বলেন, “আমরা আমাদের সবজি বাজারে নিয়ে গেলে মধ্যস্থতাকারীরা দাম কমিয়ে দেয়। সরাসরি ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আরও কৃষক বাজার দরকার।” কৃষকরা চান রাজ্য সরকার আরও কৃষক বাজার স্থাপন করুক এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তাদের পণ্য বিক্রির সুযোগ বাড়াক।

কৃষকদের কণ্ঠস্বর এবং সরকারের ভূমিকা
কৃষক সংগঠনগুলি, যেমন সম্যুক্ত কিষান মোর্চা, বাংলায় নতুন কৃষি নীতির জন্য সরকারের সঙ্গে আলোচনার দাবি জানাচ্ছে। তারা বলছে, নীতি প্রণয়নে কৃষকদের সরাসরি অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। পাঞ্জাবে ২০২৪ সালে প্রকাশিত খসড়া কৃষি নীতির সমালোচনা করে কৃষকরা বলেছেন, এটি কর্পোরেট স্বার্থকে প্রাধান্য দেয় এবং কৃষকদের সুবিধার কথা উপেক্ষা করে। বাংলার কৃষকরাও একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। তারা চান নতুন নীতি যেন কৃষককেন্দ্রিক হয় এবং কর্পোরেট বা বড় ব্যবসায়ীদের স্বার্থের পরিবর্তে ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের সুবিধা দেয়।

Advertisements

রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে কৃষি মন্ত্রী গুরমিত সিং খুদিয়ান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাঞ্জাব মান্ডি বোর্ডের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে, কৃষকরা বলছেন, এই আলোচনায় তাদের প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ জরুরি। উত্তরবঙ্গের কৃষক নেতা অমরেশ সিং বলেন, “আমাদের কথা শোনা হচ্ছে না। নীতি তৈরি হচ্ছে শহরের অফিসে, কিন্তু আমরা যারা মাঠে কাজ করি, আমাদের মতামত ছাড়া কোনও নীতি সফল হবে না।”

টেকসই কৃষির জন্য পদক্ষেপ
কৃষকরা টেকসই কৃষির জন্য সরকারি উদ্যোগ চান। তারা পরিবেশবান্ধব চাষ পদ্ধতি, যেমন কভার ক্রপিং, রোটেশনাল গ্রেজিং, এবং শূন্য-কর্ষণ চাষের জন্য সহায়তা দাবি করছেন। এই পদ্ধতিগুলি মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করে এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমায়। আমেরিকার এনভায়রনমেন্টাল কোয়ালিটি ইনসেনটিভ প্রোগ্রাম (EQIP) এবং কনজারভেশন রিজার্ভ প্রোগ্রাম (CRP)-এর মতো প্রকল্প থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে, বাংলার কৃষকরা চান রাজ্য সরকার এই ধরনের প্রোগ্রাম চালু করুক।

এছাড়া, কৃষকরা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সেচ ব্যবস্থার উন্নতি এবং বৃষ্টির জল সংরক্ষণের জন্য সরকারি সহায়তা চান। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা বলছেন, নদী ও খালের জল ব্যবস্থাপনার জন্য আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন।

পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট—তারা একটি এমন কৃষি নীতি চান যা তাদের আর্থিক সুরক্ষা দেবে, পরিবেশ রক্ষা করবে, এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কৃষিকে টেকসই করবে। MSP-এর আইনি গ্যারান্টি, জৈব চাষের জন্য সহায়তা, সহজলভ্য ঋণ, এবং বাজার সংস্কার তাদের প্রধান দাবি। রাজ্য সরকারের উপর এখন দায়িত্ব কৃষকদের এই কণ্ঠস্বর শুনে একটি কৃষককেন্দ্রিক নীতি প্রণয়ন করা। যদি এই দাবিগুলি পূরণ করা যায়, তবে পশ্চিমবঙ্গের কৃষি খাত শুধু টিকে থাকবে না, বরং একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে।