কি উপায়ে করবেন কৃষিজাত পণ্য রফতানি ? জেনে নিন

ভারত বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ কৃষি পণ্য উৎপাদনকারী দেশ, (Agricultural Products)এবং কৃষি রফতানি দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে (এপ্রিল-ডিসেম্বর) ভারতের কৃষি পণ্য রফতানির মূল্য…

Agricultural Products export procedure step by step

ভারত বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ কৃষি পণ্য উৎপাদনকারী দেশ, (Agricultural Products)এবং কৃষি রফতানি দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে (এপ্রিল-ডিসেম্বর) ভারতের কৃষি পণ্য রফতানির মূল্য ছিল ৩,১৮,৫০৯ কোটি টাকা (৩৬.৯৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। বাসমতি চাল, মশলা, ফলমূল, শাকসবজি, এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মতো পণ্য বিশ্বব্যাপী ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

কৃষক এবং কৃষি ব্যবসায়ীদের জন্য কৃষি পণ্য রফতানি আয় বৃদ্ধির একটি দুর্দান্ত সুযোগ। তবে, এই প্রক্রিয়াটি জটিল এবং নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন মেনে চলা প্রয়োজন। এই নিবন্ধে ভারত থেকে কৃষি পণ্য রফতানির প্রক্রিয়া এবং কৃষকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা তুলে ধরা হল।

   

ধাপ ১ বাজার গবেষণা এবং পণ্য নির্বাচন

কৃষি পণ্য রফতানির প্রথম ধাপ হল আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা বোঝা। ভারত থেকে রপ্তানিকৃত শীর্ষ পণ্যগুলির মধ্যে রয়েছে বাসমতি ও নন-বাসমতি চাল, মশলা, চা, ডাল, ফলমূল, শাকসবজি, এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য। ২০২২-২৩ অর্থবছরে চাল রফতানি ১৯% এবং মশলা ৮% অবদান রেখেছে মোট কৃষি রফতানিতে। কৃষকদের উচিত এমন পণ্য নির্বাচন করা যা আন্তর্জাতিক মান পাওয়ার সম্ভাবনা রাখে এবং যেখানে চাহিদা বেশি। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বাংলাদেশ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, এবং চীন ভারতীয় কৃষি পণ্যের প্রধান আমদানিকারক।

ধাপ ২ প্রয়োজনীয় নিবন্ধন ও লাইসেন্স

কৃষি পণ্য রফতানির জন্য কিছু আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয়। প্রথমত, ডিরেক্টরেট জেনারেল অফ ফরেন ট্রেড (DGFT) থেকে ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট কোড (IEC) সংগ্রহ করতে হবে। এটি একটি ১০-সংখ্যার কোড যা রফতানি ব্যবসার জন্য অপরিহার্য। এছাড়া, ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি অফ ইন্ডিয়া (FSSAI) থেকে নিবন্ধন প্রয়োজন, যা খাদ্য পণ্যের নিরাপত্তা ও মান নিশ্চিত করে।

অর্গানিক পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে NPOP (National Programme for Organic Production) সার্টিফিকেশন প্রয়োজন। এছাড়া, কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্য রফতানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (APEDA) এ নিবন্ধন করা বাধ্যতামূলক। APEDA কৃষকদের রফতানির জন্য প্রশিক্ষণ, বাজার তথ্য, এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করে।

ধাপ ৩ আন্তর্জাতিক মান ও সার্টিফিকেশন

আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে কৃষি পণ্যের গুণমান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্যানিটারি অ্যান্ড ফাইটোস্যানিটারি (SPS) এবং টেকনিক্যাল ব্যারিয়ার্স টু ট্রেড (TBT) নিয়ম মেনে চলতে হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপে বাসমতি চাল এবং চা রফতানির ক্ষেত্রে কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ পরীক্ষা করা হয়। জাপানে ফুল রপ্তানির ক্ষেত্রে কঠোর কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ নীতি রয়েছে। APEDA এবং অন্যান্য সংস্থা কৃষকদের এই মান পূরণে সহায়তা করে।

ধাপ ৪ প্যাকেজিং ও লজিস্টিকস

কৃষি পণ্য, বিশেষ করে পচনশীল পণ্য যেমন ফলমূল ও শাকসবজি, রপ্তানির জন্য উপযুক্ত প্যাকেজিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত কন্টেইনার (রেফার কন্টেইনার) এবং কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা পণ্যের গুণমান বজায় রাখে। শিপিংয়ের জন্য সমুদ্রপথে রফতানির ক্ষেত্রে সঠিক ডকুমেন্টেশন, যেমন প্যাকিং লিস্ট, ইনভয়েস, এবং শিপিং বিল প্রয়োজন। কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের জন্য কাস্টমস এজেন্টদের সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়।

ধাপ ৫: সরকারি সহায়তা ও প্রণোদনা

ভারত সরকারের কৃষি রপ্তানি নীতি (AEP) কৃষকদের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের সুযোগ দেয়। APEDA-র ফিনান্সিয়াল অ্যাসিস্ট্যান্স স্কিম (FAS) রপ্তানি পরিকাঠামো , গুণমান উন্নয়ন, এবং বাজার প্রচারে সহায়তা করে।

মার্কেট অ্যাক্সেস ইনিশিয়েটিভ (MAI) এবং অপারেশন গ্রিনস প্রকল্প কৃষকদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় অংশগ্রহণ এবং নতুন বাজার অনুসন্ধানে সহায়তা করে। এছাড়া, কৃষি পণ্যের উপর GST হার প্রাথমিক প্রক্রিয়াজাত পণ্যের জন্য ৫% এবং গৌণ প্রক্রিয়াজাত পণ্যের জন্য ১২% নির্ধারিত হয়েছে।

Advertisements

ধাপ ৬ ফার্মার প্রোডিউসার অর্গানাইজেশন (FPO)

কৃষকদের জন্য ফার্মার প্রোডিউসার অর্গানাইজেশন (FPO) এবং কো-অপারেটিভ সোসাইটি গঠন অত্যন্ত উপকারী। এই সংগঠনগুলি কৃষকদের একত্রিত করে রফতানির জন্য বড় পরিমাণে পণ্য সংগ্রহ, গুণমান নিয়ন্ত্রণ, এবং বাজার সংযোগ স্থাপনে সহায়তা করে। APEDA-র ফার্মার কানেক্ট পোর্টাল কৃষকদের রফতানিকারকদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করে।

চ্যালেঞ্জ ও সমাধান

কৃষি রফতানির ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কঠোর SPS এবং TBT নিয়ম, অস্থির বৈশ্বিক দাম, এবং পরিকাঠামোর অভাব প্রধান বাধা। উদাহরণস্বরূপ, বাসমতি চাল এবং চা রপ্তানিতে ইউরোপে কীটনাশক অবশিষ্টাংশের কারণে নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হয়েছে।

এই সমস্যা সমাধানে কৃষকদের অর্গানিক চাষ এবং কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া, সরকারের উচিত নতুন বাজার যেমন আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, এবং লাতিন আমেরিকায় রফতানি প্রচার করা।

মিউচুয়াল ফান্ড থেকে আয়, রিটার্নে কীভাবে ট্যাক্স ফাইল করবেন? জানুন বিস্তারিত

সরকারি উদ্যোগ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল ২০২৫ সালের জুলাইয়ে ঘোষণা করেছেন যে, প্রক্রিয়াজাতকরণ, ব্র্যান্ডিং, এবং প্যাকেজিংয়ে মনোযোগ দিয়ে ভারতের কৃষি রফতানি ৪.৫ লক্ষ কোটি টাকা থেকে ২০ লক্ষ কোটি টাকায় উন্নীত হতে পারে। এছাড়া, জাম, লিচু, এবং আনারসের মতো নতুন পণ্য রফতানি বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এক্স-এ এই ঘোষণা ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

ভারত থেকে কৃষি পণ্য রফতানি কৃষকদের আয় বৃদ্ধি এবং দেশের অর্থনীতি শক্তিশালী করার একটি গুরুত্বপূর্ণ পথ। সঠিক বাজার গবেষণা, আইনি নিবন্ধন, গুণমান নিয়ন্ত্রণ, এবং সরকারি সহায়তার মাধ্যমে কৃষকরা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারেন। APEDA এবং FPO-এর মতো সংস্থাগুলি এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

তবে, পরিকাঠামো উন্নয়ন, আন্তর্জাতিক মান মেনে চলা, এবং নতুন বাজার অনুসন্ধানে আরও জোর দেওয়া প্রয়োজন। কৃষকদের জন্য এটি শুধু আর্থিক লাভের পথ নয়, বরং ভারতের কৃষি ঐতিহ্যকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার একটি সুযোগ।