কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের মধ্যে অষ্টম বেতন কমিশন (8th Pay Commission) নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়ছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভা অষ্টম বেতন কমিশন গঠনের অনুমোদন দিয়েছিল, যা ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা। তবে, সম্প্রতি এই কমিশনের বাস্তবায়ন নিয়ে অনিশ্চয়তা এবং সম্ভাব্য বিলম্বের আশঙ্কায় সরকারি কর্মচারী ইউনিয়নগুলি বিক্ষোভের পরিকল্পনা করছে। এই প্রতিবেদনে আমরা অষ্টম বেতন কমিশন বাতিলের সম্ভাবনা, কর্মচারীদের প্রতিক্রিয়া এবং তাদের বিক্ষোভ পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।
অষ্টম বেতন কমিশনের গুরুত্ব
অষ্টম বেতন কমিশন প্রায় ৫০ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং ৬৫ লক্ষ পেনশনভোগীদের বেতন, ভাতা এবং পেনশন সংশোধনের জন্য গঠিত হয়েছে। এই কমিশনের লক্ষ্য মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কর্মচারীদের আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই কমিশন ২৫-৩৫% বেতন বৃদ্ধির প্রস্তাব দিতে পারে, যা ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.২৮ থেকে ২.৮৬ এর মধ্যে হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, সপ্তম বেতন কমিশন ন্যূনতম মৌলিক বেতন ৭,০০০ টাকা থেকে ১৮,০০০ টাকায় উন্নীত করেছিল। অষ্টম বেতন কমিশনের ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ হলে, ন্যূনতম বেতন ৫১,৪৮০ টাকায় পৌঁছাতে পারে।
এছাড়াও, মহার্ঘ ভাতা (ডিএ), গৃহভাড়া ভাতা (এইচআরএ), এবং ভ্রমণ ভাতা (টিএ) এর মতো সুবিধাগুলিও সংশোধিত হবে। পেনশনভোগীদের জন্য পেনশন ২০-৩০% বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। এই সংশোধনগুলি সরকারি কর্মচারীদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার পাশাপাশি অর্থনীতিতে ভোগ ব্যয় বাড়াবে।
বিলম্বের আশঙ্কা ও কর্মচারীদের উদ্বেগ
সম্প্রতি এক্স-এ পোস্ট করা তথ্য অনুযায়ী, অষ্টম বেতন কমিশনের আন্ডার সেক্রেটারি পদের আবেদনের সময়সীমা ৩১ জুলাই পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে, যা কমিশনের গঠন ও বাস্তবায়নে বিলম্বের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। এই বিলম্ব সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করেছে। কর্মচারী ইউনিয়নগুলির মতে, বর্তমান মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বেতন সংশোধন জরুরি। যদি অষ্টম বেতন কমিশন বাতিল বা বিলম্বিত হয়, তবে এটি কর্মচারীদের আর্থিক স্থিতিশীলতার উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
কর্মচারী ইউনিয়নগুলি, যেমন অল ইন্ডিয়া ফেডারেশন অফ গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ, ইতিমধ্যেই সরকারের কাছে ৩.০ থেকে ৩.৫ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টরের দাবি জানিয়েছে, যা ন্যূনতম বেতন ৬৬,২৪০ টাকা পর্যন্ত বাড়াতে পারে। তবে, প্রাক্তন অর্থ সচিব সুভাষ চন্দ্র গর্গের মতে, আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে সরকার ২.৬ ফিটমেন্ট ফ্যাক্টরের দিকে ঝুঁকতে পারে। এই অনিশ্চয়তা কর্মচারীদের মধ্যে হতাশা বাড়াচ্ছে।
বিক্ষোভ পরিকল্পনা
কর্মচারী ইউনিয়নগুলি অষ্টম বেতন কমিশন বাতিল বা বিলম্বের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের পরিকল্পনা করছে। সূত্র মারফৎ জানা গেছে, অল ইন্ডিয়া ফেডারেশন অফ গভর্নমেন্ট এমপ্লয়িজ এবং রেলওয়ে, ডাক, এবং প্রতিরক্ষা খাতের ইউনিয়নগুলি যৌথভাবে দিল্লিতে একটি বৃহৎ সমাবেশের পরিকল্পনা করছে। এই সমাবেশে লক্ষাধিক কর্মচারী অংশ নিতে পারেন। এছাড়াও, সারা দেশে ধর্মঘট, কালো ব্যাজ পরা, এবং সরকারি কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভের পরিকল্পনা রয়েছে।
ইউনিয়ন নেতারা জানিয়েছেন, যদি সরকার ২০২৬ সালের মধ্যে বেতন সংশোধন কার্যকর না করে, তবে তারা আরও কঠোর পদক্ষেপ নেবেন। এর মধ্যে রয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য কাজ বন্ধ করা এবং আইনি পদক্ষেপ। একজন ইউনিয়ন নেতা বলেন, “আমরা মুদ্রাস্ফীতির কারণে ক্রমশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। সপ্তম বেতন কমিশনের সুবিধা এখন আর পর্যাপ্ত নয়। অষ্টম বেতন কমিশন আমাদের অধিকার।”
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব
অষ্টম বেতন কমিশন বাস্তবায়নের জন্য সরকারের বার্ষিক ব্যয় প্রায় ১.৮ লক্ষ কোটি টাকা হতে পারে, যা রাজকোষের উপর চাপ সৃষ্টি করবে। তবে, এই বেতন বৃদ্ধি ভোগ ব্যয় বাড়িয়ে অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। রিয়েল এস্টেট, ভোগ্যপণ্য, এবং আর্থিক পরিষেবার মতো খাত উপকৃত হবে। অন্যদিকে, বিক্ষোভ এবং ধর্মঘট সরকারি কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করতে পারে, যা রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল হয়ে উঠতে পারে।
কর্মচারীদের প্রত্যাশা
কর্মচারীরা আশা করছেন যে অষ্টম বেতন কমিশন তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে এবং বেসরকারি খাতের সঙ্গে বেতনের ব্যবধান কমাবে। গ্রুপ সি এবং গ্রুপ ডি কর্মচারীরা বিশেষভাবে বেতন বৃদ্ধির উপর নির্ভরশীল, কারণ তাদের বর্তমান বেতন মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। এছাড়াও, পেনশনভোগীরা পেনশন বৃদ্ধি এবং চিকিৎসা সুবিধার উন্নতির দাবি জানিয়েছে।
সরকারের চ্যালেঞ্জ
সরকারের জন্য অষ্টম বেতন কমিশন বাস্তবায়ন একটি জটিল কাজ। আর্থিক ঘাটতি, রাজস্ব বৃদ্ধির চাপ, এবং রাজনৈতিক বিবেচনা এই প্রক্রিয়াকে জটিল করে তুলেছে। সরকার যদি বেতন সংশোধন বিলম্বিত বা বাতিল করে, তবে এটি কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ সৃষ্টি করবে, যা সরকারের জন্য রাজনৈতিক ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
অষ্টম বেতন কমিশন সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারে। তবে, বিলম্ব বা বাতিলের আশঙ্কায় কর্মচারী ইউনিয়নগুলি বিক্ষোভের প্রস্তুতি নিচ্ছে। সরকারকে এই দাবিগুলির সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। অষ্টম বেতন কমিশনের সফল বাস্তবায়ন শুধুমাত্র কর্মচারীদেরই নয়, সামগ্রিক অর্থনীতির জন্যও উপকারী হবে।