পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলা এবং অসমের করবি আঙ্গলং এলাকায় বিরল পৃথিবী খনিজের (Rare Earth Minerals) খোঁজ শুরু হয়েছে—এই খবরটি পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়নের জন্য একটি নতুন আলোকচিত্র আঁকছে। ভারতীয় ভূতাত্ত্বিক জরিপ দল (Geological Survey of India বা GSI) ২০২৫ সালে G2-স্তরের উন্নত অনুসন্ধান শুরু করেছে, যা পুরুলিয়া ও করবি আঙ্গলং-এ গুরুত্বপূর্ণ খনিজগুলোর সন্ধানে মনোযোগ দিচ্ছে। নিওডিমিয়াম এবং ডিসপ্রোসিয়ামের মতো এই খনিজগুলো আধুনিক প্রযুক্তি শিল্প—বিশেষ করে ব্যাটারি, চিপ, মিসাইল এবং উপগ্রহ তৈরির জন্য অপরিহার্য। ২০২৩ সালের যুক্তরাষ্ট্র ভূতাত্ত্বিক জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারত বর্তমানে প্রতি বছর মাত্র ২,৯০০ টন বিরল পৃথিবী খনিজ উৎপাদন করে, যেগুলো বেশিরভাগই হালকা খনিজ, যেখানে চীন বিশ্বের ৬০% উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে। এই নতুন উদ্যোগটি জঙ্গলমহলের অর্থনীতিতে একটি বিপ্লব আনতে পারে, যা দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়নের অপেক্ষায় ছিল।
চীনের একচেটিয়া শাসনের চ্যালেঞ্জ
বিরল পৃথিবী খনিজের বিষয়ে চীনের একচেটিয়া প্রভাব বিশ্ববাজারে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। চীন বিশ্বের ৮০% সরবরাহ শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করে, যা ভারতের মতো উদীয়মান অর্থনীতিকে আমদানির ওপর নির্ভরশীল করে রাখে। তবে এবার ভারত স্বনির্ভরতার পথে এগিয়েছে। ২০২৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ৫,০০০ কোটি টাকার একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করে, যার লক্ষ্য দেশীয় উৎপাদন বাড়ানো এবং চীনের ওপর নির্ভরতা কমানো। অর্থনৈতিক সময় পত্রিকার একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই পদক্ষেপটি ভারতের প্রযুক্তি ও শিল্পক্ষেত্রে একটি নতুন দিশা তৈরি করতে পারে। তবে উপকূলীয় বালির নিক্ষেপ থেকে খনিজ নির্যাসের প্রযুক্তিগত জটিলতা এই উদ্যোগের সামনে একটি বড় বাধা।
পুরুলিয়ার সম্ভাবনা
পুরুলিয়া জেলা, যা দীর্ঘদিন ধরে কৃষি ও প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল ছিল, এখন একটি নতুন পরিচয়ের দিকে এগোচ্ছে। GSI-এর G2-স্তরের অনুসন্ধান জটিল প্রযুক্তি ও গভীর ভূগর্ভীয় বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভারী বিরল পৃথিবী খনিজের সন্ধান করছে। যদি এই এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে খনিজ পাওয়া যায়, তবে এটি শুধুমাত্র পুরুলিয়ার অর্থনীতিকে বদলে দেবে না, বরং জঙ্গলমহলের পুরো অঞ্চলের জন্য একটি উন্নয়নের সুযোগ তৈরি করবে। ২০২৫ সালের মিন্ট নিউজে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, যদি এই জমা GSI-এর অনুমানের সাথে মিলে, তবে এটি বিশ্ববাজারে ভারতের অবস্থানকে পুনর্নির্ধারণ করতে পারে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
বিরল পৃথিবী খনিজের পৃথকীকরণের ইতিহাস ১৯৬০-এর দশকে আয়ন এক্সচেঞ্জ প্রযুক্তির মাধ্যমে একটি বড় সাফল্য ছিল। ভারত তখন থেকেই এই খনিজের সম্ভাবনা বুঝতে পেরেছিল, তবে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে নির্ভরশীলতা ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণে অগ্রগতি সীমিত ছিল। এবার ভারত অভ্যন্তরীণ এলাকায়, বিশেষ করে পুরুলিয়া ও অসমে গভীর অনুসন্ধান শুরু করেছে। এই পরিবর্তনটি শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত উন্নতির প্রমাণ নয়, বরং দেশের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব রক্ষার একটি কৌশলও।
স্থানীয় জনগণের প্রতিক্রিয়া
পুরুলিয়ার স্থানীয় বাসিন্দারা এই উদ্যোগকে নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছেন। কিছু ব্যক্তি এটিকে আর্থিক উন্নতির একটি দরজা হিসেবে দেখছেন, যা চাকরি ও উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করবে। অন্যদিকে, পরিবেশবাদীদের উদ্বেগ রয়েছে যে খনন কাজ পরিবেশে ক্ষতি করতে পারে। GSI এবং সরকারের কাছে এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব রয়েছে—সম্ভাব্য লাভের পাশাপাশি পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা।
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
এই অনুসন্ধানের ফলাফল আগামী ১২ মাসের মধ্যে স্পষ্ট হবে। যদি পুরুলিয়া ও করবি আঙ্গলং-এ পর্যাপ্ত পরিমাণে ভারী বিরল পৃথিবী খনিজ পাওয়া যায়, তবে ভারত শুধুমাত্র প্রযুক্তি শিল্পে আত্মনির্ভর হবে না, বরং বিশ্ববাজারে একটি শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলবে। পুরুলিয়ার জন্য এটি একটি নতুন যুগের শুরু হতে পারে—যেখানে জঙ্গলমহলের অর্থনীতি শিল্প ও প্রযুক্তির মাধ্যমে উন্নতির দিকে এগোবে।
সরকার এবং স্থানীয় প্রশাসনের জন্য এখন প্রয়োজন সফল বাস্তবায়নের জন্য সঠিক নীতি ও সহযোগিতা। পুরুলিয়ার এই নতুন অধ্যায়টি শুধুমাত্র অর্থনৈতিক উন্নয়ন নয়, বরং ভারতের সার্বভৌমত্ব ও গৌরবের একটি প্রতীক হিসেবে গড়ে উঠতে পারে।