ত্রিপুরায় কি বাঙালিরা অভিবাসনের কারণে চাকরি হারাচ্ছেন?

Job Crisis in Northeast India: ত্রিপুরা, উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি ক্ষুদ্র রাজ্য, যেখানে বাঙালি সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সাংস্কৃতিকভাবে প্রভাবশালী। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাঙালি সম্প্রদায়ের…

Are Bengalis in Tripura Losing Jobs to Migration? Uncovering the Job Crisis in Northeast India

Job Crisis in Northeast India: ত্রিপুরা, উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি ক্ষুদ্র রাজ্য, যেখানে বাঙালি সম্প্রদায় দীর্ঘদিন ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং সাংস্কৃতিকভাবে প্রভাবশালী। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে বেকারত্ব এবং চাকরির সুযোগ হ্রাস নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। অনেকে মনে করছেন যে, অভিবাসন, বিশেষ করে অন্য রাজ্য বা দেশ থেকে আগত শ্রমিকদের কারণে বাঙালি যুবকরা চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন। এই প্রতিবেদনে আমরা ত্রিপুরায় বাঙালি সম্প্রদায়ের বেকারত্বের সমস্যা, অভিবাসনের প্রভাব এবং এর পেছনের বাস্তবতা বিশ্লেষণ করব।

ত্রিপুরায় বেকারত্বের চিত্র
ত্রিপুরায় বেকারত্বের হার গত কয়েক বছরে উল্লেখযোগ্যভাবে ওঠানামা করেছে। ২০২২ সালে সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (CMIE)-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ত্রিপুরায় বেকারত্বের হার মে-আগস্ট মাসে ১৭% ছিল, যা উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে, ২০২৩-২৪ সালে পরিসংখ্যান ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন মন্ত্রণালয়ের পিরিয়ডিক লেবার ফোর্স সার্ভে (PLFS) অনুযায়ী, ত্রিপুরার বেকারত্বের হার ১০% থেকে কমে ১.৭%-এ নেমেছে, যা জাতীয় গড় ৩.২%-এর তুলনায় কম। এই পরিসংখ্যান সরকারের দাবি করা দক্ষতা উন্নয়ন এবং চাকরি সৃষ্টির প্রচেষ্টার ফল বলে মনে করা হচ্ছে।

   

তবে, এই উন্নতি সত্ত্বেও, বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি ধারণা প্রচলিত যে, অভিবাসী শ্রমিকরা, বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে আগত শ্রমিক বা অন্যান্য রাজ্যের শ্রমিকরা, ত্রিপুরার শ্রম বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়িয়েছে। এর ফলে স্থানীয় বাঙালি যুবকরা নিম্ন-দক্ষতার চাকরি, যেমন নির্মাণ, কৃষি, এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ হারাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

অভিবাসনের প্রভাব
ত্রিপুরার ভৌগোলিক অবস্থান এবং বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চল হওয়ায় এখানে অভিবাসন একটি সংবেদনশীল বিষয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে ত্রিপুরায় বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অভিবাসী এসেছেন। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, ত্রিপুরার জনসংখ্যার প্রায় ৩৫% বাঙালি সম্প্রদায়ের, যার মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশ থেকে আগত। এই অভিবাসন শ্রম বাজারে প্রভাব ফেলেছে, বিশেষ করে নিম্ন-দক্ষতার কাজে।

অনেক স্থানীয় বাঙালি অভিযোগ করেন যে, অভিবাসী শ্রমিকরা কম মজুরিতে কাজ করতে রাজি হওয়ায় নির্মাণ, পরিবহন, এবং কৃষি ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ কমে গেছে। উদাহরণস্বরূপ, আগরতলার একজন নির্মাণ শ্রমিক রমেন দাস জানিয়েছেন, “আমরা দিনে ৫০০ টাকা মজুরি চাই, কিন্তু অভিবাসী শ্রমিকরা ৩০০ টাকায় কাজ করতে রাজি। এর ফলে ঠিকাদাররা তাদের বেছে নেয়।” এই ধরনের পরিস্থিতি বাঙালি যুবকদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করছে।
তবে, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, অভিবাসনই একমাত্র কারণ নয়। ত্রিপুরার অর্থনীতি মূলত কৃষি এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের উপর নির্ভরশীল। শিল্প এবং সেবা খাতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগের অভাবে নতুন চাকরির সুযোগ সীমিত। এছাড়া, শিক্ষিত যুবকদের জন্য দক্ষতা-ভিত্তিক চাকরির অভাব একটি বড় সমস্যা। সিএমআইই-এর তথ্য অনুযায়ী, ত্রিপুরার শহরাঞ্চলে বেকারত্বের হার গ্রামাঞ্চলের তুলনায় বেশি (৩% বনাম ১.১%)। এটি ইঙ্গিত করে যে শিক্ষিত বাঙালি যুবকরা উপযুক্ত চাকরির অভাবে বেকার থাকছেন।

সরকারি উদ্যোগ এবং বাস্তবতা
ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সাহা দাবি করেছেন যে, বিজেপি সরকার ২০১৮ সাল থেকে চাকরি সৃষ্টি এবং দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ২২,০০০ যুবককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যার ফলে অনেকে রাজ্যের ভিতরে এবং বাইরে চাকরি পেয়েছেন। এছাড়া, ২০১৮ সাল থেকে ১৯,৪৮৪ জনকে সরকারি চাকরি দেওয়া হয়েছে। সমবায় খাতে প্রায় ৯ লক্ষ মানুষ সরাসরি বা পরোক্ষভাবে নিযুক্ত রয়েছেন।

Advertisements

তবে, বিরোধী দলগুলো, যেমন সিপিএম এবং কংগ্রেস, সরকারের এই দাবিকে চ্যালেঞ্জ করেছে। তারা দাবি করেছে যে, ত্রিপুরায় বেকারত্বের হার এখনও ১৪.৩% থেকে ১৬.৩% পর্যন্ত, যা সরকারি পরিসংখ্যানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এছাড়া, ২০২২ সালে জয়েন্ট রিক্রুটমেন্ট বোর্ড অফ ত্রিপুরা (JRBT)-এর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশে বিলম্বের কারণে ৮১,০০০ চাকরিপ্রার্থী অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছিলেন।

বাঙালি সম্প্রদায়ের উপর প্রভাব
বাঙালি সম্প্রদায়, যারা ত্রিপুরার জনসংখ্যার একটি বড় অংশ, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে বেকারত্বের সমস্যায় ভুগছেন। শিক্ষিত যুবকরা সরকারি চাকরি বা উচ্চ-দক্ষতার কাজের জন্য প্রতিযোগিতায় অংশ নেন, কিন্তু সীমিত সুযোগের কারণে অনেকে ব্যর্থ হন। গ্রামাঞ্চলে, অভিবাসী শ্রমিকদের কম মজুরিতে কাজ করার প্রবণতা স্থানীয় বাঙালিদের জন্য নিম্ন-দক্ষতার কাজের সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে। এছাড়া, মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি আইন (MGNREGA)-এর তহবিল হ্রাস এবং বাস্তবায়নের সমস্যা গ্রামীণ বাঙালিদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত করেছে।

সমাধানের পথ
ত্রিপুরায় বাঙালি সম্প্রদায়ের বেকারত্বের সমস্যা সমাধানের জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ প্রয়োজন:

  • শিল্পায়ন এবং বিনিয়োগ: ত্রিপুরায় শিল্প এবং সেবা খাতে বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। আইটি, পর্যটন, এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের মতো খাতে নতুন সুযোগ সৃষ্টি করা যেতে পারে।
  • দক্ষতা উন্নয়ন: বাঙালি যুবকদের জন্য দক্ষতা-ভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম বাড়ানো উচিত। মুখ্যমন্ত্রী দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের মতো উদ্যোগ আরও প্রসারিত করা প্রয়োজন।
  • বাজার নিয়ন্ত্রণ: অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়োগে ন্যূনতম মজুরি নীতি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা উচিত, যাতে স্থানীয় শ্রমিকরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে না পড়েন।
  • সরকারি চাকরির স্বচ্ছতা: সরকারি চাকরির নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং দ্রুততা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। JRBT-এর ফলাফল বিলম্বের মতো ঘটনা এড়ানো উচিত।
  • MGNREGA-র বাস্তবায়ন: গ্রামীণ কর্মসংস্থানের জন্য MGNREGA-র তহবিল বাড়ানো এবং কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা উচিত।

ত্রিপুরায় বাঙালি সম্প্রদায়ের বেকারত্বের সমস্যা জটিল এবং বহুমুখী। অভিবাসন এই সমস্যার একটি অংশ হলেও, শিল্পায়নের অভাব, দক্ষতা-ভিত্তিক চাকরির সীমিত সুযোগ, এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা এই সংকটকে আরও গভীর করেছে। সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগ যেমন দক্ষতা উন্নয়ন এবং সরকারি চাকরি প্রদান ইতিবাচক হলেও, আরও ব্যাপক এবং কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন। বাঙালি যুবকদের জন্য ন্যায্য চাকরির সুযোগ নিশ্চিত করতে সরকার, বেসরকারি খাত, এবং সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। ত্রিপুরার অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে এবং বাঙালি সম্প্রদায়ের আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে এখনই সময়মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।