বাজার সমস্যা! ভালো ফলন সত্ত্বেও কেন সংগ্রাম করছেন বাংলার কৃষকরা

পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা (Bengal Farmers) দীর্ঘদিন ধরে কৃষি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন। ধান, গম, পাট, আলু এবং শাকসবজির মতো ফসলের ভালো ফলন সত্ত্বেও তারা অর্থনৈতিকভাবে…

Bengal Farmers Face Challenges

পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা (Bengal Farmers) দীর্ঘদিন ধরে কৃষি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছেন। ধান, গম, পাট, আলু এবং শাকসবজির মতো ফসলের ভালো ফলন সত্ত্বেও তারা অর্থনৈতিকভাবে সফল হতে পারছেন না। এর পেছনে রয়েছে বাজার ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, মধ্যস্থতাকারীদের শোষণ এবং সরকারি নীতির ত্রুটি। এই প্রতিবেদনে আমরা বাংলার কৃষকদের সম্মুখীন বাজার সমস্যাগুলোর বিশ্লেষণ করব এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।

কৃষকদের সম্মুখীন প্রধান সমস্যা
পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের মধ্যে প্রায় ৯০% হলেন ছোট এবং প্রান্তিক কৃষক, যাঁদের জমির পরিমাণ এক হেক্টরেরও কম। এই ছোট জমির খণ্ডিতকরণ তাদের উৎপাদনশীলতা এবং লাভের সম্ভাবনাকে সীমিত করে। জনসংখ্যার চাপে জমি ক্রমাগত ভাগ হয়ে যাওয়ায় কৃষি কার্যক্রম অর্থনৈতিকভাবে অলাভজনক হয়ে পড়ছে। এছাড়া, বাজারে প্রবেশাধিকারের অভাব, মধ্যস্থতাকারীদের দৌরাত্ম্য এবং অপর্যাপ্ত স্টোরেজ সুবিধা কৃষকদের আয়ের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

   

বাজার অবকাঠামোর অভাব: পশ্চিমবঙ্গে কৃষক বাজার বা মান্ডির সংখ্যা অপ্রতুল। রাজ্যের কৃষি বিপণন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, মাত্র ১৮৬টি কৃষক বাজার রয়েছে, যা প্রতি ব্লকে একটি করে। এর ফলে অনেক কৃষক মান্ডিতে পৌঁছাতে পারেন না এবং স্থানীয় বাজারে মধ্যস্থতাকারীদের কাছে তাদের ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হন। এই মধ্যস্থতাকারীরা কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে ফসল কিনে বাজারে উচ্চ মূল্যে বিক্রি করে, যার ফলে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন।

দামের অস্থিরতা: ফসলের দামের অস্থিরতা বাংলার কৃষকদের জন্য আরেকটি বড় সমস্যা। উদাহরণস্বরূপ, উত্তর ২৪ পরগনার মাথুরাপুর গ্রামের কৃষক ফারুক মণ্ডল জানিয়েছেন, তিনি ফুলকপি চাষে প্রতি ফুলকপিতে ২ টাকা খরচ করেন, কিন্তু বাজারে তা ২ টাকাতেই বিক্রি হয়। এই অবস্থায় কৃষকদের কোনো লাভ হয় না। আলুর ক্ষেত্রেও একই সমস্যা দেখা যায়। হুগলি জেলার ধনিয়াখালিতে আলু চাষিরা জানিয়েছেন, পুখরাজ জাতের আলু জানুয়ারি মাসে বাজারে আসে, কিন্তু দাম এত কম থাকে (প্রতি কেজি ১-২ টাকা) যে তারা লোকসানের মুখে পড়েন। স্টোরেজের অভাবে তারা ফসল রাখতে পারেন না, ফলে দ্রুত বিক্রি করতে বাধ্য হন।

স্টোরেজ এবং পরিবহনের সমস্যা: পশ্চিমবঙ্গে কোল্ড স্টোরেজ এবং গুদামের সংখ্যা অপ্রতুল। ফল, শাকসবজি, তৈলবীজ এবং ডালের মতো পচনশীল ফসলের প্রায় ১৬% নষ্ট হয়ে যায়। এই ক্ষতি কৃষকদের আয়কে আরও কমিয়ে দেয়। এছাড়া, গ্রামীণ এলাকায় রাস্তা এবং পরিবহন ব্যবস্থার অভাবে কৃষকরা তাদের ফসল বাজারে পৌঁছে দিতে পারেন না। হাওড়ার ফুল বাজারে কৃষকরা সরাসরি ফুল বিক্রি করতে পারেন না, কারণ পাইকাররা তাদের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখে। এই সমস্যা আলু এবং পান পাতার ক্ষেত্রেও দেখা যায়।

Advertisements

ঋণের জাল এবং মধ্যস্থতাকারীদের শোষণ: বাংলার কৃষকদের মধ্যে অনেকেই মাইক্রোফাইনান্স কোম্পানি বা স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নেন। উচ্চ সুদের হার এবং ফসলের কম দামের কারণে তারা এই ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না। হুগলির একজন আলু চাষি রনি জানিয়েছেন, তিনি ডিএপি সারের জন্য প্রতি প্যাকেট ২,৩৫০ টাকা দিয়েছেন, যেখানে বাজার মূল্য ছিল মাত্র ১,৬৫০ টাকা। এই অতিরিক্ত খরচ তাদের লাভের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: জলবায়ু পরিবর্তন বাংলার কৃষকদের জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। অপ্রত্যাশিত বৃষ্টি, খরা এবং বন্যার কারণে ফসলের ক্ষতি হয়। বর্ধমান জেলার জৌগ্রাম গ্রামের কৃষক সাজেদ মৌলিক জানিয়েছেন, ২০১৯ সালে দক্ষিণবঙ্গে বিলম্বিত বর্ষার কারণে ধানের চারা রোপণে সমস্যা হয়েছিল। এই ধরনের আবহাওয়ার অনিশ্চয়তা কৃষকদের উৎপাদন পরিকল্পনাকে ব্যাহত করে।

Bengal Farmers Face Challenges
Bengal Farmers Face Challenges

সমাধানের পথ
বাংলার কৃষকদের এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। কিছু সম্ভাব্য সমাধান নিম্নরূপ:

  • বাজার সংস্কার: কৃষি উৎপাদ বিপণন কমিটি (এপিএমসি) আইনের সংস্কার এবং ই-ন্যাম (ন্যাশনাল এগ্রিকালচারাল মার্কেট) প্ল্যাটফর্মের প্রসার কৃষকদের বাজারে সরাসরি প্রবেশাধিকার দেবে। এটি মধ্যস্থতাকারীদের প্রভাব কমাবে এবং কৃষকদের ন্যায্য দাম পেতে সহায়তা করবে।
  • স্টোরেজ এবং পরিবহন উন্নয়ন: কোল্ড স্টোরেজ এবং গুদামের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। গ্রামীণ এলাকায় রাস্তা এবং পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতি কৃষকদের ফসল বাজারে পৌঁছে দিতে সহায়ক হবে।
  • ঋণ এবং বীমা সুবিধা: প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনার (পিএমএফবিওয়াই) মতো বীমা প্রকল্পগুলোর প্রচার এবং সহজলভ্য ঋণ সুবিধা কৃষকদের আর্থিক সুরক্ষা দেবে। এছাড়া, মাইক্রোফাইনান্স সংস্থাগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো প্রয়োজন।
  • প্রযুক্তি এবং প্রশিক্ষণ: আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, যেমন উচ্চ ফলনশীল বীজ, ড্রিপ সেচ এবং নির্ভুল কৃষি, কৃষকদের মধ্যে প্রচার করা উচিত। সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালানো যেতে পারে।
  • জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা: জলবায়ু-সহনশীল ফসলের জাত এবং টেকসই কৃষি পদ্ধতি প্রচার করা দরকার। সেচ ব্যবস্থার উন্নতি এবং জল সংরক্ষণ কৌশল কৃষকদের আবহাওয়ার অনিশ্চয়তার সঙ্গে মানিয়ে নিতে সহায়তা করবে।

পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা ভালো ফলন সত্ত্বেও বাজার সমস্যার কারণে অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হচ্ছেন। অপ্রতুল বাজার অবকাঠামো, মধ্যস্থতাকারীদের শোষণ, দামের অস্থিরতা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব তাদের জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। সরকার, বেসরকারি সংস্থা এবং কৃষক সংগঠনগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই সমস্যাগুলোর সমাধান সম্ভব। বাজার সংস্কার, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং প্রযুক্তির প্রয়োগ কৃষকদের ন্যায্য মূল্য এবং আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারে। এই পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা হলে বাংলার কৃষকরা তাদের কঠোর পরিশ্রমের প্রকৃত ফল ভোগ করতে পারবেন।