ভারতে সোনা কেবলমাত্র একটি অলঙ্কার বা গহনা নয়, এটি আর্থিক স্থিতি এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের (Gold investment) প্রতীক। দীর্ঘদিন ধরেই সোনাকে মূল্য সংরক্ষণের অন্যতম নিরাপদ মাধ্যম এবং মুদ্রাস্ফীতির হাত থেকে বাঁচার অন্যতম ভরসাযোগ্য উপায় হিসেবে দেখা হয়। চলতি বছরের জুলাই ১২ তারিখে দিল্লিতে সোনার দাম কিছুটা কমে হয়েছে প্রতি ১০ গ্রাম ৯৯,৮৬০ টাকা। ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত হওয়া এবং বাজারের পুনর্গঠন এই মূল্যের হ্রাসের প্রধান কারণ। তবুও, ভারতীয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সোনার জনপ্রিয়তা আজও অটুট।
তবে সোনায় বিনিয়োগের জন্য অনেক ক্ষেত্রেই বড় অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন হয়, যা অনেকের কাছেই ভয়ঙ্কর বলে মনে হয়। এই প্রেক্ষাপটে অনেকেই ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে সোনা কেনার কথা ভাবেন, যা সহজে অর্থপ্রদানের সুযোগ দেয় এবং সাথে সাথে সোনার মালিকানাও প্রদান করে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুবিধার পাশাপাশি রয়েছে বেশ কিছু ঝুঁকি ও নিয়মাবলী, যা জানা অত্যন্ত প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞদের মতামত:
ফাইনান্সিয়াল প্ল্যানিং ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান FPA Edutech-এর ডিরেক্টর সিএ প্রণীত জৈন এর মতে, “ক্রেডিট কার্ড শুধুমাত্র সেইসব ব্যক্তিদের জন্য, যারা অত্যন্ত নিয়মিত এবং সময়মতো পেমেন্ট করতে সক্ষম। ক্রেডিট কার্ডে রিওয়ার্ড পয়েন্ট পাওয়ার সুযোগ থাকলেও, সময়মতো পেমেন্ট না করলে তা দ্রুতই বড় ধরনের আর্থিক সমস্যায় পরিণত হতে পারে। বিনিয়োগের জন্য ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার একেবারেই এড়ানো উচিত।”
অন্যদিকে CashKaro ও EarnKaro-র সহ-প্রতিষ্ঠাতা রোহন ভরগব বলেন, “ক্রেডিট কার্ড বুদ্ধিমত্তার সাথে এবং সতর্কতার সাথে ব্যবহার করা উচিত। পূর্ণ অর্থ একবারে মিটিয়ে দেওয়া বা শূন্য খরচের EMI সুবিধা ব্যবহার করলে ঋণের ফাঁদে পড়ার ঝুঁকি কমানো সম্ভব।”
নিয়ম এবং সীমাবদ্ধতা:
রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া (RBI) সোনা কেনার জন্য ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারে বেশ কিছু নিয়ম আরোপ করেছে, যাতে দেশের স্বর্ণ মজুত রক্ষিত থাকে। এর মধ্যে রয়েছে:
সোনা কেনার লেনদেনকে EMI তে রূপান্তর করা যাবে না।
ব্যাংক শাখা থেকে সোনার কয়েন কেনার ক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার নিষিদ্ধ।
এই নিয়মগুলি মূলত সোনার কয়েনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও, কিছু ব্যাংক গহনার EMI সুবিধাও বন্ধ করে দিয়েছে। তাই, সোনা কেনার আগে অবশ্যই নিজের ব্যাংক বা কার্ড ইস্যুয়ারের কাছ থেকে সাম্প্রতিক নীতি জেনে নেওয়া উচিত।
চার্জ এবং গোপন খরচ:
ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সোনা কেনার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত চার্জ থাকতে পারে, যা সাধারণত ‘সুইপ ফি’ নামে পরিচিত। এই চার্জ ব্যাংক এবং মার্চেন্ট অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। সাধারণত যা যা খরচ থাকে:
প্রসেসিং/সুইপ ফি: প্রতি লেনদেনে প্রায় ৩.৫% পর্যন্ত হতে পারে।
সুদ: নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পূর্ণ অর্থ না মেটালে, বার্ষিক ৩৬-৪২% হারে সুদ ধার্য হয়।
লেট পেমেন্ট ফি: নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ন্যূনতম অর্থ পরিশোধ না করলে অতিরিক্ত জরিমানা।
EMI রূপান্তর সুবিধা নেই: বেশিরভাগ ব্যাংক সোনা কেনার ক্ষেত্রে EMI সুবিধা বন্ধ রেখেছে।
বিদেশি লেনদেন ফি: আন্তর্জাতিক সোনার সরবরাহকারীর কাছ থেকে কিনলে প্রযোজ্য।
রিওয়ার্ড এবং বেনিফিট:
কিছু ক্রেডিট কার্ড সোনা ও গহনা কেনায় আকর্ষণীয় ক্যাশব্যাক বা রিওয়ার্ড পয়েন্ট অফার করে। তবে, এগুলো নির্দিষ্ট মার্চেন্টের সাথেই সীমাবদ্ধ এবং প্রায়ই শর্তযুক্ত ও নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে।
সুরক্ষা ও সুবিধা:
ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সোনা কেনার একটি বড় সুবিধা হল সুরক্ষা। নগদ অর্থ বহনের ঝুঁকি কমে এবং অনলাইন ট্র্যাকিংয়ের মাধ্যমে খরচ সহজে মনিটর করা যায়। তাছাড়া, জালিয়াতি বা পণ্যের অপ্রাপ্তি হলে কার্ডের মাধ্যমে সুরক্ষা পাওয়া যায়।
সবদিক বিবেচনা করলে বলা যায়, ক্রেডিট কার্ড দিয়ে সোনা কেনা সুবিধাজনক হলেও এর সাথে রয়েছে ঝুঁকি এবং অতিরিক্ত খরচের বোঝা। বিনিয়োগের আগে একজন সার্টিফাইড ফাইনান্সিয়াল অ্যাডভাইজারের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক সময়ে পেমেন্ট করা এবং সমস্ত শর্তাবলী ভালোভাবে বোঝা ছাড়া এই ধরনের লেনদেন এড়ানোই বুদ্ধিমানের কাজ। বিনিয়োগকারীদের উচিত নিজের আর্থিক লক্ষ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বিবেচনা করে পদক্ষেপ নেওয়া। অন্যথায়, সোনার জায়গায় হতে পারে ২৪ ক্যারেটের আফসোস।