দক্ষিণবঙ্গে নতুন লাভজনক ড্রাগন বিন চাষের প্রবল সম্ভাবনা

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। দক্ষিণবঙ্গের কৃষকরা এখন ড্রাগন বিন নামে পরিচিত একটি বহিরাগত সবজির চাষ (Dragon Bean Cultivation) শুরু করেছেন, যা…

New Vegetable Alert: Dragon Bean Cultivation Takes Root in South Bengal for 2025

পশ্চিমবঙ্গের কৃষি ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। দক্ষিণবঙ্গের কৃষকরা এখন ড্রাগন বিন নামে পরিচিত একটি বহিরাগত সবজির চাষ (Dragon Bean Cultivation) শুরু করেছেন, যা উইংড বিন বা গোয়া বিন নামেও পরিচিত। এই নতুন ফসলটি, যার বৈজ্ঞানিক নাম Psophocarpus tetragonolobus, পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অর্থনীতিতে একটি নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে। এই ফসলটি তার পুষ্টিগুণ, বহুমুখী ব্যবহার এবং উচ্চ বাজার চাহিদার কারণে কৃষকদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করছে। ২০২৫ সালে, দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলো, বিশেষ করে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর, এবং হাওড়ার মতো অঞ্চলে, এই বিন চাষের জন্য উপযুক্ত জমি এবং জলবায়ু পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে কৃষকরা নতুন পথে হাঁটছেন। এই নিবন্ধে আমরা ড্রাগন বিন চাষের সম্ভাবনা, চ্যালেঞ্জ এবং এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করব।

ড্রাগন বিন কী এবং এর গুরুত্ব
ড্রাগন বিন, যা উইংড বিন বা গোয়া বিন নামে পরিচিত, একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় লেগুম ফসল, যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পাপুয়া নিউ গিনি এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্যাপকভাবে জন্মায়। এই ফসলের ফল, পাতা, ফুল, এবং এমনকি শিকড়ও ভোজ্য। ড্রাগন বিন প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন এ, সি, এবং খনিজ পদার্থে সমৃদ্ধ, যা এটিকে একটি পুষ্টিকর সবজি হিসেবে গড়ে তুলেছে। এর ফলগুলো সবজি হিসেবে, শুকনো বীজ পালস হিসেবে এবং পাতাগুলো পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর চারটি ডানার মতো গঠনের কারণে এটি ‘উইংড বিন’ নামে পরিচিত, যা এটিকে একটি অনন্য চেহারা দেয়।

   

পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গে, এই ফসলের চাষ এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে, এর উচ্চ পুষ্টিগুণ এবং রপ্তানি বাজারে চাহিদার কারণে কৃষকরা এটির দিকে ঝুঁকছেন। ড্রাগন বিনের চাষে তুলনামূলকভাবে কম পানির প্রয়োজন হয় এবং এটি বিভিন্ন ধরনের মাটিতে জন্মাতে পারে, যা দক্ষিণবঙ্গের কৃষকদের জন্য একটি বড় সুবিধা।

দক্ষিণবঙ্গে ড্রাগন বিন চাষের সূচনা
দক্ষিণবঙ্গের উষ্ণ এবং আর্দ্র জলবায়ু ড্রাগন বিন চাষের জন্য আদর্শ। দক্ষিণ ২৪ পরগনার বারুইপুর এবং ক্যানিং, পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক এবং হাওড়ার উলুবেড়িয়ার মতো এলাকায় কৃষকরা এই ফসলের চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। স্থানীয় কৃষি বিভাগ এবং গবেষণা সংস্থাগুলো, যেমন কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র, কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং উন্নত বীজ সরবরাহ করছে। উদাহরণস্বরূপ, বারুইপুরে একটি কৃষক সমিতি ২০২৪ সালে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্পে ড্রাগন বিন চাষ শুরু করেছে, যা সফল ফলাফল দেখিয়েছে। এই প্রকল্পে প্রতি হেক্টরে ৮০-১০০ কুইন্টাল ফলন পাওয়া গেছে, যা স্থানীয় বাজারে প্রতি কেজি ৬০-৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

ড্রাগন বিন চাষে সাধারণত জুলাই মাসে বীজ বপন করা হয়, যা বর্ষার শুরুতে শুরু হয়। ফসলটি ফুল ফোটে নভেম্বরে এবং জানুয়ারির মধ্যে ফলনের জন্য প্রস্তুত হয়। প্রতি হেক্টরে ১০-১২ কেজি বীজ প্রয়োজন হয় এবং সঠিক ব্যবধান (১ মিটার x ১ মিটার) এবং ট্রেলিস বা বাঁশের কাঠামোর সাহায্যে ফসলটি জন্মানো হয়।

New Vegetable Alert: Dragon Bean Cultivation Takes Root in South Bengal for 2025
New Vegetable Alert: Dragon Bean Cultivation Takes Root in South Bengal for 2025

ড্রাগন বিন চাষের সুবিধা
ড্রাগন বিন চাষের বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে, যা কৃষকদের আকর্ষণ করছে:

Advertisements
  • পুষ্টিগুণ: ড্রাগন বিন প্রোটিন (২৫-৩৫%), ফাইবার এবং ভিটামিনে সমৃদ্ধ। এটি হজমশক্তি উন্নত করে, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
  • কম রক্ষণাবেক্ষণ: এই ফসলটি বেশি সেচের প্রয়োজন হয় না এবং বর্ষায় প্রাকৃতিকভাবে জন্মায়। তবে, গ্রীষ্মকালে সপ্তাহে একবার এবং শীতকালে দুই সপ্তাহে একবার সেচ দেওয়া যায়।
  • বাজার চাহিদা: স্থানীয় এবং রপ্তানি বাজারে ড্রাগন বিনের চাহিদা বাড়ছে। কলকাতার মতো শহরে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাজারে এর চাহিদা উল্লেখযোগ্য।
  • বহুমুখী ব্যবহার: ফল, বীজ, পাতা এবং শিকড় সবই ব্যবহারযোগ্য। শুকনো বীজ পালস হিসেবে এবং পাতা পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
    মাটির উন্নতি: লেগুম ফসল হওয়ায় এটি মাটিতে নাইট্রোজেন স্থির করে, যা মাটির উর্বরতা বাড়ায়।

চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
ড্রাগন বিন চাষে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। প্রথমত, কৃষকদের মধ্যে এই ফসল সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে। অনেক কৃষক ঐতিহ্যগত ফসল যেমন ধান বা পাটের উপর নির্ভরশীল। দ্বিতীয়ত, প্রাথমিক বিনিয়োগে ট্রেলিস বা সমর্থন কাঠামো তৈরির জন্য খরচ হয়, যা প্রতি একরে ৫০,০০০-৭০,০০০ টাকা হতে পারে। তৃতীয়ত, উন্নত বীজের প্রাপ্যতা এবং বাজার সংযোগ এখনও সীমিত।

এই সমস্যা সমাধানের জন্য সরকার এবং কৃষি গবেষণা সংস্থাগুলো উদ্যোগ নিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার কৃষকদের জন্য ভর্তুকি এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করছে। উদাহরণস্বরূপ, বারুইপুর ড্রাগন ফ্রুট ফার্মের মতো উদ্যোগ কৃষকদের উৎসাহিত করছে এবং নতুন ফসলের প্রচারে সহায়তা করছে। এছাড়াও, কৃষক সমিতি এবং স্থানীয় বাজারের সাথে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে বাজার সমস্যা সমাধান করা হচ্ছে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
ড্রাগন বিন চাষ দক্ষিণবঙ্গের কৃষকদের জন্য একটি নতুন আয়ের উৎস হতে পারে। এই ফসলের রপ্তানি সম্ভাবনা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে, বিশেষ করে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ফিলিপাইনে, উল্লেখযোগ্য। এটি স্থানীয় বাজারে স্বাস্থ্য সচেতন গ্রাহকদের মধ্যেও জনপ্রিয় হচ্ছে। কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, ড্রাগন বিনের চাষ ২০২৮ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গে আরও বিস্তৃত হবে, যদি সরকারি উদ্যোগ এবং বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ে।
এছাড়াও, ড্রাগন বিনের সাথে ইন্টারক্রপিং (যেমন ভুট্টা, মাটিশস্য বা সরগম) কৃষকদের অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ দেয়। এই ফসলটি জৈব চাষের জন্যও উপযুক্ত, যা পরিবেশবান্ধব এবং স্বাস্থ্যকর পণ্যের চাহিদা পূরণ করে।

দক্ষিণবঙ্গে ড্রাগন বিন চাষ কৃষকদের জন্য একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এই বহিরাগত সবজিটি তার পুষ্টিগুণ, বহুমুখী ব্যবহার এবং বাজার চাহিদার কারণে কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তবে, এই চাষের সফলতার জন্য সচেতনতা বৃদ্ধি, উন্নত বীজের প্রাপ্যতা এবং বাজার সংযোগ জরুরি। সরকার, কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র এবং কৃষক সমিতির সমন্বিত প্রচেষ্টায় ড্রাগন বিন পশ্চিমবঙ্গের কৃষি অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠতে পারে। ২০২৫ সালে, এই ফসল কৃষকদের জন্য নতুন আশার আলো হয়ে উঠবে বলে আশা করা যায়।