পশ্চিমবঙ্গে পাট ‘সোনালি আঁশ’ (Jute in West Bengal) নামে পরিচিত৷ একসময় এই অঞ্চলের অর্থনীতির মেরুদণ্ড ছিল। এই ফসলটি কেবলমাত্র কৃষকদের জন্যই নয়, বরং লক্ষ লক্ষ শ্রমিক এবং পাটকলের সঙ্গে যুক্ত পরিবারের জন্য জীবিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস ছিল। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পশ্চিমবঙ্গের কৃষকরা পাট চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। পাটের উৎপাদন এবং চাষের জমির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০১১-১২ সালে যেখানে পাটের উৎপাদন ছিল ২০.৩ লক্ষ টন, সেখানে ২০২৪-২৫ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৪.৪ লক্ষ টনে। এই হ্রাসের পিছনে রয়েছে একাধিক কারণ, যার মধ্যে রয়েছে অপ্রতুল বাজার চাহিদা, কম মূল্য, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এই নিবন্ধে আমরা পশ্চিমবঙ্গে পাট চাষের পতনের কারণ এবং কৃষকদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করব।
পাট চাষ ছেড়ে দেওয়ার কারণ
১. কম মূল্য এবং বাজার সমস্যা
পাট চাষের প্রধান সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি হলো এর জন্য ন্যায্য মূল্যের অভাব। সরকার ২০২৪-২৫ মরসুমের জন্য পাটের ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (এমএসপি) নির্ধারণ করেছে ৫,৩৩৫ টাকা প্রতি কুইন্টাল। তবে, বাজারে পাটের দাম প্রায়ই এই মূল্যের নিচে নেমে যায়। উদাহরণস্বরূপ, মুর্শিদাবাদ এবং কোচবিহারের মতো জেলাগুলোতে পাটের দাম ১,৮০০ থেকে ২,০০০ টাকা প্রতি কুইন্টালে নেমে গেছে। এই কম দামের কারণে কৃষকরা স্থানীয় বিক্রেতাদের কাছে পাট বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন, যা তাদের আর্থিক ক্ষতির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। জুট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (জেসিআই) কৃষকদের জন্য এমএসপি নিশ্চিত করার চেষ্টা করলেও, পরিবহন খরচ এবং নিম্নমানের পাটের কারণে অনেক কৃষক এই সুবিধা গ্রহণ করতে পারছেন না।
২. জলবায়ু পরিবর্তন এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ
পাট চাষের জন্য প্রয়োজনীয় উষ্ণ এবং আর্দ্র জলবায়ু পশ্চিমবঙ্গে প্রাকৃতিকভাবে পাওয়া যায়। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তন এবং অপ্রত্যাশিত আবহাওয়া পাট চাষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। ২০২০ সালে আমফান ঘূর্ণিঝড় এবং তার পরবর্তী অতিবৃষ্টির কারণে পাটের উৎপাদন এবং গুণমান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গিয়েছিল। জলাবদ্ধতার কারণে কৃষকরা ফসল অকালে কাটতে বাধ্য হয়েছিলেন, যা ফাইবারের গুণমানকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। ২০২৩ সালে কোচবিহারে অপ্রতুল বৃষ্টিপাতের কারণে পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা ৪৫,০০০ হেক্টর থেকে কমে ৩৮,৮০০ হেক্টরে নেমে আসে। এই ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষকদের পাট চাষে আগ্রহ হারাতে বাধ্য করছে।
৩. শ্রম সংকট এবং প্রযুক্তিগত পশ্চাৎপদতা
পাট চাষ একটি শ্রমনির্ভর কাজ, যার মধ্যে রয়েছে রেটিং (পাটের আঁশ পৃথক করার প্রক্রিয়া) এবং ফসল কাটা। শ্রমিকের অভাব এবং উচ্চ শ্রম খরচ কৃষকদের জন্য পাট চাষকে অলাভজনক করে তুলেছে। এছাড়াও, আধুনিক প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতির অভাব পাট চাষের খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও হ্যাপি সিডারের মতো প্রযুক্তি কোচবিহারের মতো অঞ্চলে পরীক্ষামূলকভাবে সফল হয়েছে, তবে এটি এখনও ব্যাপকভাবে গৃহীত হয়নি।
৪. বিকল্প ফসলের প্রতি আকর্ষণ
পাটের তুলনায় বিকল্প ফসল যেমন ভুট্টা, ডাল, এবং কলা বেশি লাভজনক হওয়ায় কৃষকরা এই ফসলের দিকে ঝুঁকছেন। মুর্শিদাবাদ এবং নদীয়ার মতো জেলায় কৃষকরা গমের পরিবর্তে কলা এবং ভুট্টা চাষ শুরু করেছেন, যা তাদের বেশি আয় দিচ্ছে। রাজ্য সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত দশকে ভুট্টার চাষের ক্ষেত্রফল আট গুণ এবং ডালের চাষ তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ফসলগুলো কম ঝুঁকিপূর্ণ এবং বাজারে ভালো দাম পাওয়া যায়।
৫. পাটকলের সংকট
পশ্চিমবঙ্গে ৭০টি পাটকল রয়েছে, যা দেশের মোট ৯৩টি পাটকলের একটি বড় অংশ। তবে, এই পাটকলগুলো আধুনিকীকরণের অভাব, শ্রমিক অসন্তোষ, এবং কাঁচা পাটের উচ্চ মূল্যের কারণে সংকটের মুখে রয়েছে। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে কাঁচা পাটের দাম ৬,৫০০ টাকা প্রতি কুইন্টালে সীমাবদ্ধ করার সরকারি সিদ্ধান্ত পাটকলগুলোর জন্য লোকসানের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, কারণ তারা ৭,০০০-৭,২০০ টাকায় কাঁচা পাট কিনতে বাধ্য হয়েছিল। এর ফলে অনেক পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে, যা কৃষকদের পাট বিক্রির বাজারকে আরও সংকুচিত করেছে।

ভবিষ্যতে কী হবে?
১. বিকল্প ফসলের প্রতি ঝোঁক
পাট চাষের পরিবর্তে কৃষকরা ভুট্টা, ডাল, কলা, এবং অন্যান্য শাকসবজির দিকে ঝুঁকছেন। এই ফসলগুলোর জন্য বাজারে চাহিদা বেশি এবং আবহাওয়ার ঝুঁকি কম। উদাহরণস্বরূপ, ভুট্টার উৎপাদন ২০১১ সালে ৩.২৫ লক্ষ টন থেকে ২০২৩ সালে ২৯ লক্ষ টনে উন্নীত হয়েছে। এই ফসলগুলো কৃষকদের জন্য আর্থিকভাবে স্থিতিশীলতা প্রদান করছে।
২. প্রযুক্তিগত উন্নয়ন
পাট চাষের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, যেমন হ্যাপি সিডার এবং জৈব রেটিং প্রযুক্তি (যেমন CRIJAF-SONA), কৃষকদের খরচ কমাতে এবং ফলন বাড়াতে সাহায্য করছে। কোচবিহারে এই প্রযুক্তিগুলো সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে, যা কৃষকদের মধ্যে আগ্রহ জাগিয়েছে। তবে, এই প্রযুক্তিগুলো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগের প্রয়োজন।
৩. সরকারি উদ্যোগ
সরকার পাট চাষকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন জুট-আইসিএআরই প্রকল্প এবং এমএসপি বৃদ্ধি। ২০২৫-২৬ মরসুমের জন্য এমএসপি ৬% বাড়িয়ে ৫,৬৫০ টাকা প্রতি কুইন্টাল করা হয়েছে। তবে, কৃষকদের মতে, এই বৃদ্ধি এখনও পর্যাপ্ত নয়। সরকারকে বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং পাটকলগুলোর আধুনিকীকরণে আরও বিনিয়োগ করতে হবে।
৪. বৈচিত্র্যকরণ এবং রপ্তানি
পাটের বৈচিত্র্যকরণ, যেমন পাটের তৈরি পোশাক, হস্তশিল্প, এবং জিওটেক্সটাইল পণ্য, এই শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে। ভারতের তুলনায় বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে, কারণ তারা পাট পণ্যের জন্য ভর্তুকি প্রদান করে। ভারতের সরকার এবং শিল্পপতিদের এই দিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
পশ্চিমবঙ্গে পাট চাষের পতন কৃষকদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ, তবে এটি নতুন সম্ভাবনার দ্বারও উন্মোচন করছে। বিকল্প ফসল এবং আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ কৃষকদের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রদান করতে পারে। তবে, পাট শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে হলে সরকারকে বাজার ব্যবস্থাপনা, পাটকলের আধুনিকীকরণ, এবং কৃষকদের জন্য প্রণোদনা বাড়াতে হবে। পাট চাষের ভবিষ্যৎ এখন কৃষক, সরকার, এবং শিল্পপতিদের সমন্বিত প্রচেষ্টার উপর নির্ভর করছে।