১৯৯৮ সালে ভারত সরকার কর্তৃক চালু হওয়া কিষাণ ক্রেডিট কার্ড (Kisan Credit Card) প্রকল্প কৃষকদের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল। এই প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকরা স্বল্প সুদে ঋণ পেয়ে থাকেন, যা তাঁদের কৃষি কাজের জন্য বীজ, সার, কীটনাশক কেনা থেকে শুরু করে পশুপালন, মৎস্য চাষ এবং অন্যান্য সম্পর্কিত কার্যক্রমে বিনিয়োগের জন্য ব্যবহার করতে পারেন। ২০২৫ সালে এসে এই প্রকল্পের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। মুর্শিদাবাদ জেলার কৃষকদের মধ্যে মাঠ পর্যায়ের একটি সমীক্ষা এই প্রকল্পের বর্তমান অবস্থা এবং এর প্রভাব সম্পর্কে গভীর তথ্য দিয়েছে।
কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের প্রাসঙ্গিকতা
মুর্শিদাবাদ, পশ্চিমবঙ্গের একটি কৃষি প্রধান জেলা, যেখানে ধান, পাট, এবং শাকসবজি চাষ প্রধান জীবিকা। এই জেলার কৃষকরা দীর্ঘদিন ধরে কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা গ্রহণ করে আসছেন। ২০২৫ সালের অর্থনৈতিক জরিপ অনুযায়ী, মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত দেশে ৭.৭৫ কোটি কিষাণ ক্রেডিট কার্ড সক্রিয় ছিল, যার মাধ্যমে ৯.৮১ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। মুর্শিদাবাদেও এই প্রকল্পের মাধ্যমে হাজার হাজার কৃষক ঋণ পেয়েছেন। তবে, প্রশ্ন উঠছে—এই কার্ড কি এখনও কৃষকদের জন্য প্রকৃত সমাধান দিচ্ছে?
মুর্শিদাবাদের মাঠের চিত্র
মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন ব্লকে, যেমন বহরমপুর, লালগোলা, এবং জঙ্গিপুর, আমরা স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের অভিজ্ঞতা জানার চেষ্টা করেছি। স্থানীয় কৃষক মহম্মদ সেখ জানান, “কিষাণ ক্রেডিট কার্ড আমার জন্য একটি বড় সহায়ক। আমি প্রতি বছর ধান ও পাট চাষের জন্য ৫০,০০০ টাকা পর্যন্ত ঋণ পাই। এই টাকা দিয়ে বীজ ও সার কিনি। তবে, ব্যাংকের কাগজপত্রের জটিলতা এবং ঋণ পেতে দেরি হওয়া আমাদের সমস্যায় ফেলে।” সেখের মতো অনেক কৃষকই মনে করেন যে KCC তাঁদের কৃষি কাজে সাহায্য করলেও, এর প্রয়োগে এখনও অনেক ঘাটতি রয়েছে।
অন্যদিকে, লালগোলার কৃষক রিনা খাতুন জানান, “আমি ২০২৩ সালে কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের জন্য আবেদন করেছিলাম, কিন্তু দুই মাস পরেও কোনও সাড়া পাইনি। শেষ পর্যন্ত আমাকে স্থানীয় মহাজনের কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিতে হয়েছিল।” এই অভিযোগ শুধু রিনার নয়, মুর্শিদাবাদের অনেক কৃষকেরই। ব্যাংকের কঠিন নিয়ম, কাগজপত্রের জটিলতা এবং সময়মতো ঋণ না পাওয়া অনেক কৃষককে বিকল্প অ-প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
প্রকল্পের সুবিধা
কিষাণ ক্রেডিট কার্ড প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকরা ৭% সুদে ঋণ পান, যা সময়মতো পরিশোধ করলে ৪% পর্যন্ত কমে যায়। ২০২৫ সালের বাজেটে ঘোষণা করা হয়েছে যে কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের ঋণের সীমা ৩ লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ লক্ষ টাকা করা হবে। এছাড়া, ডিজিটাল কিষাণ ক্রেডিট কার্ড এবং কিষাণ রিন পোর্টালের মাধ্যমে ঋণ প্রক্রিয়া আরও সহজ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মুর্শিদাবাদের কিছু কৃষক, যেমন বহরমপুরের অমিত মণ্ডল, জানান যে তিনি KCC-এর মাধ্যমে পাওয়া ঋণ দিয়ে একটি ছোট মুরগির খামার শুরু করেছেন, যা তাঁর আয়ের একটি অতিরিক্ত উৎস হয়ে উঠেছে।
তবে, সুবিধার পাশাপাশি সমস্যাও রয়েছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে KCC গ্রহণকারী কৃষকদের ফসলের উৎপাদনশীলতা এবং আয় বেশি হয়, কিন্তু ঋণের পরিমাণ প্রায়ই তাঁদের চাহিদার তুলনায় কম থাকে। মুর্শিদাবাদের কৃষকরা জানিয়েছেন যে ঋণের সীমা বৃদ্ধি সত্ত্বেও, জমির মালিকানার প্রমাণ এবং অন্যান্য কাগজপত্র জোগাড় করা তাঁদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ
মুর্শিদাবাদের কৃষকদের মধ্যে কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের গ্রহণযোগ্যতা বাড়লেও, বেশ কিছু সমস্যা এখনও প্রকট। প্রথমত, ঋণ প্রক্রিয়ার জটিলতা এবং ব্যাংকের ধীরগতির সেবা। দ্বিতীয়ত, অনেক কৃষকের কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, যেমন জমির দলিল বা আধার কার্ডের সঙ্গে সংযুক্তি, থাকে না। তৃতীয়ত, কিষাণ রিন পোর্টালের মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম সম্পর্কে সচেতনতার অভাব। জঙ্গিপুরের কৃষক সুজন শেখ বলেন, “আমরা ডিজিটাল পোর্টালের কথা শুনেছি, কিন্তু গ্রামে ইন্টারনেট সুবিধা কম, আর ব্যাংকের লোকজনও সঠিকভাবে বোঝায় না।”
এছাড়া, কিছু কৃষক অভিযোগ করেছেন যে KCC ঋণ প্রায়ই তাঁদের পুরো চাহিদা মেটায় না। উদাহরণস্বরূপ, মাঝারি ও বড় কৃষকরা যেখানে বেশি ঋণ পান, সেখানে ছোট ও প্রান্তিক কৃষকরা কম ঋণ পান, যা তাঁদের চাহিদার তুলনায় অপর্যাপ্ত। এছাড়া, কিছু ক্ষেত্রে ঋণের অপব্যবহারের অভিযোগও উঠেছে, যেমন স্কুল ফি, চিকিৎসা বা এমনকি বিয়ের খরচের জন্য KCC ঋণ ব্যবহার।
সরকারি উদ্যোগ
২০২৫ সালের বাজেটে কিষাণ ক্রেডিট কার্ডের ঋণ সীমা বৃদ্ধি এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের প্রসার ঘোষণা করা হয়েছে। কিষাণ ঋণ পোর্টালের মাধ্যমে ঋণ প্রক্রিয়া ডিজিটাল করা হচ্ছে, এবং আধার সংযুক্তির মাধ্যমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হচ্ছে। তবে, মুর্শিদাবাদের গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগ এবং ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব এই উদ্যোগের সাফল্যে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
কিষাণ ক্রেডিট কার্ড প্রকল্প মুর্শিদাবাদের কৃষকদের জন্য এখনও প্রাসঙ্গিক, তবে এর কার্যকারিতা বাড়াতে আরও কিছু পদক্ষেপ প্রয়োজন। ব্যাংকের প্রক্রিয়া সহজ করা, গ্রামীণ এলাকায় ডিজিটাল সচেতনতা বাড়ানো, এবং ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি করা জরুরি। মুর্শিদাবাদের কৃষকরা এই প্রকল্পের মাধ্যমে তাঁদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে পারেন, তবে সরকার এবং ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোর আরও সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। এই প্রকল্প যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে তা মুর্শিদাবাদের কৃষি অর্থনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।