কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী ও পেনশনভোগীদের বেতন এবং ভাতার সংশোধনের জন্য অষ্টম বেতন কমিশনের (8th Pay Commission) গঠন ঘোষণা করা হয়েছে ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে। এই কমিশনের সুপারিশ ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা প্রায় ৫০ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারী এবং ৬৫ লক্ষ পেনশনভোগীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই বিশাল দায়িত্ব পালনের জন্য সরকারের শীর্ষস্থানীয় আমলারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যাঁরা কমিশনের সুপারিশ তৈরির কাজে নিযুক্ত হয়েছেন। এই প্রতিবেদনে আমরা জানব অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশ প্রণয়নে নেতৃত্ব দেওয়া শীর্ষ পাঁচ আমলার সম্পর্কে।
অষ্টম বেতন কমিশন: পটভূমি
ভারত সরকার প্রতি দশকে একবার বেতন কমিশন গঠন করে, যা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের বেতন, ভাতা এবং পেনশনের কাঠামো পর্যালোচনা করে। সপ্তম বেতন কমিশন ২০১৬ সালে কার্যকর হয়েছিল, যা ন্যূনতম বেতন ৭,০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৮,০০০ টাকা করেছিল এবং ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর নির্ধারণ করেছিল ২.৫৭। অষ্টম বেতন কমিশনের লক্ষ্য হলো বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বিবেচনা করে বেতন ও ভাতার কাঠামো সংশোধন করা। এই কমিশনের সুপারিশে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৫৭ থেকে ২.৮৬ বা তার বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা ন্যূনতম বেতন ১৮,০০০ টাকা থেকে ৪১,০০০ থেকে ৫১,৪৮০ টাকায় উন্নীত করতে পারে।
শীর্ষ পাঁচ আমলার ভূমিকা
অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশ তৈরির জন্য সরকার শীর্ষস্থানীয় আমলাদের নিয়োগ করেছে। যদিও কমিশনের চেয়ারম্যান এবং সদস্যদের নাম এখনও চূড়ান্তভাবে ঘোষণা করা হয়নি, সূত্রের খবর অনুযায়ী, নিম্নলিখিত পাঁচজন আমলা এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন:
১. টিভি সোমনাথন (ক্যাবিনেট সেক্রেটারি): ভারত সরকারের শীর্ষ আমলা হিসেবে, টিভি সোমনাথন অষ্টম বেতন কমিশনের গঠন এবং এর কার্যক্রমের তত্ত্বাবধানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ন্যাশনাল কাউন্সিল-জয়েন্ট কনসালটেটিভ মেশিনারি (NC-JCM)-এর সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর অভিজ্ঞতা এবং প্রশাসনিক দক্ষতা কমিশনের সুপারিশকে দিকনির্দেশনা দেবে।
২. শিব গোপাল মিশ্র (NC-JCM স্টাফ সাইড সেক্রেটারি): কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের প্রতিনিধিত্বকারী NC-JCM-এর সেক্রেটারি হিসেবে, শিব গোপাল মিশ্র একটি “কমন মেমোরেন্ডাম” তৈরির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই মেমোরেন্ডামে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর, ন্যূনতম বেতন, ভাতা এবং পেনশন সুবিধার বিষয়ে দাবি উত্থাপিত হয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের একটি কমিটি জুন ২০২৫-এ সুপারিশ চূড়ান্ত করতে বৈঠক করেছে।
৩. অশ্বিনী বৈষ্ণব (কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী): রেলমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালনকারী অশ্বিনী বৈষ্ণব অষ্টম বেতন কমিশনের ঘোষণা এবং এর প্রাথমিক পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি জানিয়েছেন যে কমিশনের চেয়ারম্যান এবং দুই সদস্য শীঘ্রই নিযুক্ত হবেন এবং সুপারিশগুলি ২০২৬ সালের মধ্যে কার্যকর হবে।
৪. সুভাষ চন্দ্র গর্গ (প্রাক্তন অর্থ সচিব): যদিও তিনি বর্তমানে সরকারি পদে নেই, তাঁর অর্থনৈতিক বিষয়ে অভিজ্ঞতা এবং পূর্ববর্তী বেতন কমিশনের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করা হচ্ছে। তিনি ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ১.৯২-এর পক্ষে মত দিয়েছেন, যা কর্মচারী ইউনিয়নের দাবির তুলনায় কম।
৫. অজয় কুমার ভাল্লা (গৃহ সচিব): অজয় কুমার ভাল্লা প্রশাসনিক সংস্কার এবং নীতি বাস্তবায়নে তাঁর দক্ষতার জন্য পরিচিত। তিনি কমিশনের সুপারিশে প্রশাসনিক এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত কর্মচারীদের জন্য বিশেষ বিবেচনার বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন।
সুপারিশের মূল বিষয়
অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর, ন্যূনতম বেতন, ভাতা এবং পেনশন সংস্কারের উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। NC-JCM ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ৩.৬৮-এর দাবি জানিয়েছে, যদিও সরকার ২.৫৭ থেকে ২.৮৬-এর মধ্যে স্থির করতে পারে। এছাড়া, নিম্ন পে-লেভেলগুলোর একত্রীকরণ (যেমন লেভেল ১ এবং ২, ৩ এবং ৪) এবং মডিফাইড অ্যাসিওর্ড ক্যারিয়ার প্রোগ্রেশন (MACP) স্কিমে সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে। মহার্ঘ ভাতা (DA) ৫৫% এ পৌঁছেছে, এবং নতুন কমিশন এটি বেসিক বেতনের সঙ্গে একত্রিত করতে পারে।
অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব
এই কমিশনের সুপারিশ কেবলমাত্র কর্মচারীদের আর্থিক নিরাপত্তা বাড়াবে না, বরং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে। বেতন বৃদ্ধির ফলে কর্মচারীদের ব্যয় ক্ষমতা বাড়বে, যা ভোগ বৃদ্ধি এবং বাজারে অর্থ প্রবাহকে উৎসাহিত করবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, অষ্টম বেতন কমিশন দেশের জিডিপিতে ১.৫% অবদান রাখতে পারে।
চ্যালেঞ্জ ও প্রত্যাশা
অষ্টম বেতন কমিশনের সুপারিশ তৈরির কাজে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। টার্মস অফ রেফারেন্স (ToR) এখনও চূড়ান্ত হয়নি, যা প্রক্রিয়ায় বিলম্বের কারণ হতে পারে। এছাড়া, কর্মচারী ইউনিয়ন এবং সরকারের মধ্যে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। তবে, শীর্ষ আমলাদের অভিজ্ঞতা এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সরকারের তৎপরতা এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়ক হবে।
অষ্টম বেতন কমিশন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করতে চলেছে। শীর্ষ আমলাদের নেতৃত্বে এই কমিশনের সুপারিশ শুধুমাত্র আর্থিক সুবিধাই নয়, সরকারি চাকরির প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে এবং প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখবে। কুমারটুলির মতো ঐতিহ্যবাহী স্থানের সংস্কারে আদানি গোষ্ঠীর উদ্যোগের মতো, অষ্টম বেতন কমিশনও ভারতের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে আরও শক্তিশালী করবে। এই প্রক্রিয়ায় শীর্ষ আমলাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এবং তাঁদের দক্ষতা ও দূরদর্শিতা দেশের প্রশাসনিক ভবিষ্যৎ গঠনে সহায়ক হবে।