নতুন শিল্প নীতি ও ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দুর্লভ মাটি (Rare Earth) চুম্বক উৎপাদকদের (Magnet Manufacturing) জন্য ১,৩৪৫ কোটি টাকার ভর্তুকি দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। শুক্রবার কেন্দ্রীয় ভারী শিল্প মন্ত্রী এইচ. ডি. কুমারস্বামী এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান।
মন্ত্রী কুমারস্বামী বলেন, “১,৩৪৫ কোটি টাকার একটি ভর্তুকি প্রকল্পের খসড়া তৈরি হয়েছে। এটি বর্তমানে আন্তঃমন্ত্রক পরামর্শ প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। প্রাথমিকভাবে দু’টি উৎপাদককে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব রয়েছে, তবে প্রকল্প চূড়ান্ত হওয়ার পর এই সংখ্যা পরিবর্তিত হতে পারে।”
ভারী শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরান রিজভি আরও জানান, যারা অক্সাইড থেকে শুরু করে চূড়ান্ত চুম্বক উৎপাদন পর্যন্ত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবেন, তারাই এই ভর্তুকির জন্য যোগ্য হবেন।
রিজভি বলেন, “আমরা চুম্বক উৎপাদকদের উৎসাহিত করতে চাই। যে কোনো কোম্পানি আমাদের চুম্বক সরবরাহ করবে, তারা প্রণোদনা পাবে। এটি প্রথম প্রস্তাব, যা আমরা আন্তঃমন্ত্রক পরামর্শের জন্য পাঠিয়েছি। প্রাথমিকভাবে দু’জন উৎপাদক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।”
দেশীয় চুম্বক উৎপাদনে আগ্রহ প্রকাশ করেছে দেশের অন্যতম স্বনামধন্য গাড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থা মহীন্দ্রা অ্যান্ড মহীন্দ্রা এবং স্বয়ংচালিত যন্ত্রাংশ উৎপাদক কোম্পানি উনো মিন্ডা।
গত জুনে ভারী শিল্প মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে মহীন্দ্রা অ্যান্ড মহীন্দ্রা জানিয়েছে, তারা হয় কোনো অভিজ্ঞ উৎপাদক সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে চায় অথবা কোনো দেশীয় উৎপাদকের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে যেতে চায়। উল্লেখযোগ্য যে, মহীন্দ্রা অ্যান্ড মহীন্দ্রা বর্তমানে দেশের অন্যতম প্রধান বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারী সংস্থা।
অন্যদিকে, উনো মিন্ডা মারুতি সুজুকির মতো শীর্ষ গাড়ি নির্মাতাদের বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে। দেশের বৈদ্যুতিক যানবাহন এবং অটো ইন্ডাস্ট্রির দ্রুত বর্ধনের কারণে দেশে চুম্বকের চাহিদা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের ভিতরে চুম্বক উৎপাদন শুরু হলে শুধু বৈদ্যুতিক যানবাহনের খরচ কমবে না, বরং বৈদেশিক নির্ভরতা কমিয়ে দেশের আত্মনির্ভরতা বাড়বে।
বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ দুর্লভ মাটি চুম্বক চীনের উপর নির্ভরশীল। সম্প্রতি চীন আমেরিকার ওপর শুল্ক বৃদ্ধি এবং অন্যান্য বাণিজ্য বিরোধের প্রতিশোধ হিসেবে এই চুম্বকের রপ্তানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে। এর ফলে ভারতের মতো দেশগুলিতেও এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
দুর্লভ মাটি চুম্বক বিভিন্ন অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অপরিহার্য উপাদান। ইলেকট্রনিক পণ্য, বৈদ্যুতিক যানবাহন, বড় শিল্পযন্ত্রপাতি, কম্পিউটার হার্ডডিস্ক, লাউডস্পিকার, হেডফোন এবং এমআরআই স্ক্যানারের মতো চিকিৎসা সরঞ্জামেও এই চুম্বকের ব্যবহার দেখা যায়।
বিশেষ করে বৈদ্যুতিক মোটর এবং উইন্ড টারবাইনে এই চুম্বকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এর উচ্চ ক্ষমতার কারণে ছোট আকারেই শক্তিশালী চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করা যায়, যা বৈদ্যুতিক মোটরের কার্যক্ষমতা বাড়ায় এবং গাড়ির ওজন কমাতে সহায়ক হয়।
দেশীয় উৎপাদনের জন্য যে ভর্তুকি প্রস্তাব করা হয়েছে, তা বেসরকারি ও সরকারি উভয় ক্ষেত্রের কোম্পানির জন্য প্রযোজ্য হবে। এতে করে দেশীয় উদ্যোগের বিকাশ ত্বরান্বিত হবে এবং ভবিষ্যতে রপ্তানির সুযোগও তৈরি হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
সরকারের এই উদ্যোগের ফলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এবং দেশে দুর্লভ মাটি খনিজের প্রক্রিয়াজাতকরণ ও চুম্বক উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি ও পরিকাঠামো তৈরি হবে। এটি ভারতের ‘আত্মনির্ভর ভারত’ (Self-reliant India) লক্ষ্য পূরণের পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
উল্লেখযোগ্য যে, সরকার এর আগে সেমিকন্ডাক্টর, সোলার প্যানেল, ব্যাটারি ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত উপাদান উৎপাদনের জন্যও বিভিন্ন প্রণোদনা প্রকল্প চালু করেছে। দুর্লভ মাটি চুম্বক উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই প্রকল্প সফল হলে, এটি দেশের উচ্চ প্রযুক্তি শিল্পের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হয়ে উঠবে।
মোট কথা, চীনের রপ্তানি সীমাবদ্ধতার কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক চুম্বক সংকটের প্রেক্ষাপটে ভারতের এই পদক্ষেপ শুধু দেশের প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকেই নয়, বরং বিশ্ব বাজারে ভারতের প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান শক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।