প্যান্ডেমিক-পরবর্তী সময়ে দেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (NSE)-এর মার্কেট পালস রিপোর্টে বলা হয়েছে, আর্থিক বছর ২০২৩-২৪ (FY24)-এ হাউসহোল্ড ঋণ (Household Credit) জিডিপির ৪২.১ শতাংশে পৌঁছেছে, যেখানে ২০১২-১৩ থেকে ২০১৯-২০ সময়কালে এই অনুপাত ৩২ থেকে ৩৫ শতাংশের মধ্যে স্থিতিশীল ছিল।
এই ঋণ বৃদ্ধির প্রবণতা দেশের অর্থনীতির মজবুত ভিত্তি এবং সাধারণ মানুষের আর্থিক ব্যবস্থার প্রতি ক্রমবর্ধমান আস্থারই ইঙ্গিত দেয়। রিপোর্টে বলা হয়েছে, প্যান্ডেমিকের আগে হাউসহোল্ড ঋণ স্থিতিশীল থাকলেও, FY21-এ তা লাফিয়ে ৩৯.৯ শতাংশে পৌঁছায় এবং এরপর FY24-এ তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে ৪২.১ শতাংশে পৌঁছায়।
প্যান্ডেমিকের সময়ে মানুষের খরচ কমে গিয়েছিল এবং সঞ্চয়ের প্রবণতা অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। সেই সময়ে নেট হাউসহোল্ড ফিনান্সিয়াল সেভিংস জিডিপির ১১.৭ শতাংশে পৌঁছায়। এই সঞ্চয় বৃদ্ধি পেয়েছিল মূলত স্বাস্থ্য সঙ্কটের কারণে সুরক্ষা মনোভাব এবং কম খরচের প্রবণতার জন্য।
তবে, প্যান্ডেমিকের প্রভাব কমতে শুরু করার পর থেকে ধীরে ধীরে সেই সঞ্চয়ের হার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। FY24-এ নেট হাউসহোল্ড সেভিংস নেমে এসেছে জিডিপির ৫.২ শতাংশে। এই হ্রাসের পেছনে মূল কারণ হিসেবে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে হাউসহোল্ড ফিনান্সিয়াল লাইবিলিটি বা আর্থিক দায়বদ্ধতার বৃদ্ধি। FY21-এ যা ছিল জিডিপির ৩.৭ শতাংশ, তা FY24-এ বেড়ে হয়েছে ৬.২ শতাংশ।
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, FY21-এ হাউসহোল্ড ফিনান্সিয়াল লাইবিলিটি ছিল প্রায় ৭.৪ লাখ কোটি টাকা, যা FY24-এ বেড়ে ১৮.৮ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। অর্থাৎ মাত্র তিন বছরে প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে এই আর্থিক দায়বদ্ধতা।
এই আর্থিক দায়বদ্ধতার বৃদ্ধি নেট ফিনান্সিয়াল সেভিংসকে চাপে ফেলেছে। FY21-এ যেখানে সেভিংসের পরিমাণ ছিল ২৩.৩ লাখ কোটি টাকা, FY24-এ তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১৫.৫ লাখ কোটি টাকায়।
এই প্রেক্ষাপটে দেশের ব্যক্তিগত খরচের (প্রাইভেট কনজাম্পশন) ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব পড়েছে। FY23 থেকে FY25 সময়কালে ব্যক্তিগত খরচের গড় বৃদ্ধি হার ৬.৭ শতাংশ বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ দেশের পরিবারগুলো ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে আরও বেশি খরচ করতে শুরু করেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ঋণ বৃদ্ধির পেছনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। প্রথমত, ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে, ফলে গ্রাহকদের মধ্যে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, পোস্ট-প্যান্ডেমিক সময়ে মানুষের জীবনযাত্রা ও ক্রয়ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের জন্য ঋণ একটি কার্যকর হাতিয়ার হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ফিনটেক এবং ডিজিটাল লোন পরিষেবার প্রসার। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সহজে এবং দ্রুত ঋণ পাওয়ার সুবিধা মানুষের মধ্যে ঋণ নেওয়ার প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করেছে। পাশাপাশি, সরকারি এবং নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নীতি এবং বিভিন্ন প্রণোদনাও এই ধারাটিকে সমর্থন করেছে।
তবে, বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন যে ঋণ গ্রহণের এই প্রবণতা সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে ভবিষ্যতে আর্থিক ঝুঁকির সম্ভাবনা বাড়তে পারে। ঋণ গ্রহণের মাধ্যমে অর্থনীতিতে চাহিদা বৃদ্ধি পেলেও, অতিরিক্ত ঋণ মানুষের ব্যক্তিগত আর্থিক স্থিতির জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
NSE-এর রিপোর্টে বলা হয়েছে, ঋণ এবং সেভিংসের এই পরিবর্তন সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে ইতিবাচক অবদান রাখছে। দেশের গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলের মানুষ নতুন করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছেন এবং নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সম্ভাবনাও তৈরি হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদদের মতে, ভবিষ্যতে সঠিক নীতি এবং নিয়ন্ত্রকের তত্ত্বাবধানে এই ঋণ প্রবাহ দেশের স্থায়ী আর্থিক বিকাশের জন্য সহায়ক হতে পারে। তবে, এর সঙ্গে সঙ্গেই প্রয়োজন আর্থিক সচেতনতা এবং দায়িত্বশীল ঋণ ব্যবস্থাপনা।
সার্বিকভাবে দেখা যাচ্ছে, প্যান্ডেমিক-পরবর্তী সময়ে দেশের হাউসহোল্ড ঋণ প্রবণতা এবং সঞ্চয় পরিস্থিতির মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য তৈরি হয়েছে। অর্থনীতি যেখানে পুনরুদ্ধারের পথে, সেখানে গ্রাহক আস্থার এই উত্থান ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক রূপকথার নতুন অধ্যায় রচনা করছে।