খুন-ধর্ষণ-তাণ্ডব! ১১ মাসে ২৫০০ হিংসা, বাংলাদেশে বিপন্ন সংখ্যালঘুরা

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হিংসার এক অবিশ্বাস্য ঘটনার (Bangladesh Minority Violence) সাক্ষী হয়েছে দেশটি। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের (BHBCUC) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানা গেছে,…

Bangladesh Sees Over 2,500 Minority Violence Incidents in 11 Months

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হিংসার এক অবিশ্বাস্য ঘটনার (Bangladesh Minority Violence) সাক্ষী হয়েছে দেশটি। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের (BHBCUC) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানা গেছে, গত ১১ মাসে—২০২৪ সালের ৪ আগস্ট থেকে ২০২৫ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত—সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে ২,৫০০টিরও বেশি হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে। এই হিংসার মধ্যে রয়েছে খুন, নারীদের উপর অত্যাচার, ধর্ষণ ও গ্যাং ধর্ষণ, ধর্মীয় উপাসনালয়ের ভাঙচুর, ধর্ম নিন্দার অভিযোগে গ্রেপ্তার, বাড়ি-দোকানের জোরপূর্বক দখল, ছোট সম্প্রদায়ের উপর আক্রমণ এবং জোরপূর্বক পদত্যাগের মতো ভয়াবহ কাণ্ড। এই প্রতিবেদনটি গত বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই, জাতীয় প্রেস ক্লাবের আবদুস সালাম অডিটোরিয়ামে এক প্রেস কনফারেন্সে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।

পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৪ আগস্ট থেকে ২০ আগস্টের মধ্যে প্রায় ২,০১০টি হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে, যা শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক উত্তেজনার শীর্ষবিন্দুতে ঘটেছে। এর পর ২০২৪ সালের ২১ আগস্ট থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আরও ১৩২টি ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে, আর ২০২৫ সালের শুরু থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ২৫৮টি নতুন হিংসার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এই হিংসার শিকার হয়েছেন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পুরুষ, নারী ও কিশোর-কিশোরী। প্রেস কনফারেন্সে পরিষদের একজন সভাপতি নির্মল রোসারিও জানিয়েছেন, “আমরা দেখছি, অস্থায়ী সরকারের সংস্কার কার্যক্রমে সংখ্যালঘুদের মতামত বিবেচনা করা হচ্ছে না। এটা সব সংখ্যালঘু নাগরিকের জন্য অত্যন্ত হতাশাজনক।”

   

রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার মধ্যে এই হিংসার ঘটনা একটি গভীর চিন্তার বিষয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর থেকে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বাড়ি, ব্যবসা ও ধর্মীয় স্থানগুলো উৎসাহী আক্রমণের শিকার হয়েছে। পুলিশ তদন্তে জানা গেছে, আগস্ট মাসের ৫ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের ৯৮.৪% ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কারণই প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। তবে, BHBCUC দাবি করে যে, নয়জন হিন্দু পুরুষের মৃত্যু সাম্প্রদায়িক কারণে ঘটেছে। এই দ্বন্দ্বের মাঝে অস্থায়ী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ১৩ আগস্টে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে সংখ্যালঘুদের নিশ্চিত করেছিলেন যে তারা সমান নাগরিক। তিনি বলেছিলেন, “সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের কথা অতিরঞ্জিত হয়েছে এবং এগুলো বেশি রাজনৈতিক প্রকৃতির।”

তবে, সংখ্যালঘু নেতারা এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। তাদের মতে, সরকার হিংসার ঘটনাগুলোকে রাজনৈতিক ট্যাগ দিয়ে অস্বীকার করছে এবং আসল অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনছে না। পরিষদের কার্যকর সাধারণ সম্পাদক মণীন্দ্র কুমার নাথ বলেন, “সরকার আসলে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের ঘটনাগুলো উপেক্ষা করছে। আমরা ন্যায়বিচারের দাবি করি।” তিনি আরও জানিয়েছেন যে, সংস্কার কমিশনগুলোতে সংখ্যালঘুদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই, যা বৈষম্য ও অত্যাচারের এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে।

Advertisements

ঐতিহাসিকভাবে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর হিংসা নতুন নয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিহারি সম্প্রদায়ের উপর হামলা থেকে শুরু করে ১৯৯২ ও ২০০১ সালের রাজনৈতিক উত্তেজনায় হিন্দুদের উপর আক্রমণ—এই ঘটনাগুলো দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতিফলন। গত বছরের ঘটনা এই ধরনের একটি শৃঙ্খল ভাঙার পরিচয় দেয়। ২০২৩ সালের জনগণনা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৭ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৯০% মুসলমান, ৮% হিন্দু, এবং বাকি ২% বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান। কিন্তু এই সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা বাড়ছে, বিশেষ করে যেহেতু অনেকে দেশ ত্যাগ করছেন।

সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানা গেছে, হিংসার ফলে অন্তত ৪৫ জনের মৃত্যু ঘটেছে, আর নারী ও শিশুদের উপর অত্যাচারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে, তবে সরকারের উদাসীনতা এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। সংখ্যালঘু নেতারা দাবি করছেন যে, একটি পৃথক সংখ্যালঘু কমিশন গঠন করে এই অত্যাচারের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া উচিত, যা এখন পর্যন্ত বাস্তবে রূপায়ণ করা হয়নি।

এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের সামাজিক সংহতি ও শান্তির জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, নতুবা এই হিংসার রক্তক্ষয়ী চক্র থামবে না।