কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী এবং পেনশনভোগীদের বেতন ও ভাতার কাঠামো পর্যালোচনার জন্য গঠিত অষ্টম বেতন কমিশন (8th Pay Commission) ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ঘোষণা করা হয়েছে, এবং এর সুপারিশগুলি ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই কমিশন প্রায় ৫০ লক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী এবং ৬৫ লক্ষ পেনশনভোগীর জন্য বেতন, ভাতা এবং পেনশন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসবে। এই প্রতিবেদনে আমরা বিশেষভাবে মহিলা সরকারি কর্মীদের উপর এই কমিশনের সম্ভাব্য প্রভাব এবং তাদের জন্য নতুন সুবিধাগুলি নিয়ে আলোচনা করব।
অষ্টম বেতন কমিশনের প্রধান উদ্দেশ্য
অষ্টম বেতন কমিশনের মূল লক্ষ্য হলো কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মীদের বেতন কাঠামো, ভাতা এবং পেনশন পুনর্বিবেচনা করে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মুদ্রাস্ফীতি এবং জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। এই কমিশনের সুপারিশগুলি মহিলা কর্মীদের জন্য বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সরকারি চাকরিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা ও সুরক্ষার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। মহিলা কর্মীদের জন্য প্রসূতি সুবিধা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং কাজ-জীবনের ভারসাম্য নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলি এই কমিশনের আলোচনায় গুরুত্ব পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মহিলা কর্মীদের জন্য সম্ভাব্য সুবিধা
১. বেতন বৃদ্ধি এবং ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর: অষ্টম বেতন কমিশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর, যা বেতন এবং পেনশন পুনঃনির্ধারণের জন্য ব্যবহৃত হয়। সপ্তম বেতন কমিশনে এই ফ্যাক্টর ছিল ২.৫৭, যার ফলে ন্যূনতম বেতন ৭,০০০ টাকা থেকে বেড়ে ১৮,০০০ টাকা হয়েছিল। অষ্টম বেতন কমিশনে এই ফ্যাক্টর ২.২৮ থেকে ২.৮৬-এর মধ্যে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর ফলে ন্যূনতম বেতন ১৮,০০০ টাকা থেকে ৪১,০০০ থেকে ৫১,৪৮০ টাকায় উন্নীত হতে পারে। মহিলা কর্মীদের জন্য এই বেতন বৃদ্ধি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে।
২. প্রসূতি ও শিশু যত্ন সুবিধা: মহিলা কর্মীদের জন্য প্রসূতি ছুটি এবং শিশু যত্ন সুবিধা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সপ্তম বেতন কমিশন প্রসূতি ছুটিকে ১৮০ দিন থেকে বাড়িয়ে ২৬ সপ্তাহ করেছিল। অষ্টম বেতন কমিশন এই সুবিধা আরও উন্নত করতে পারে, যেমন শিশু যত্ন ছুটি (Child Care Leave) বৃদ্ধি বা নমনীয় কাজের সময়সূচির বিষয়ে নতুন নীতি প্রবর্তন। এছাড়া, কর্মক্ষেত্রে শিশু যত্ন কেন্দ্র (crèche) স্থাপনের জন্য অতিরিক্ত তহবিল বরাদ্দের প্রস্তাবও থাকতে পারে। এই সুবিধাগুলি মহিলা কর্মীদের কাজ এবং পারিবারিক দায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হবে।
৩. ভাতার পরিবর্তন: অষ্টম বেতন কমিশন মহিলা কর্মীদের জন্য বিভিন্ন ভাতা, যেমন হাউস রেন্ট অ্যালাউন্স (HRA), ট্রান্সপোর্ট অ্যালাউন্স (TA) এবং ডিয়ারনেস অ্যালাউন্স (DA) পুনর্বিবেচনা করবে। বর্তমানে DA বেসিক বেতনের ৫৫% (জানুয়ারি ২০২৫ থেকে কার্যকর), এবং এটি ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে ৭০% পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। এই ভাতাগুলি মহিলা কর্মীদের জন্য জীবনযাত্রার ব্যয় মেটাতে সহায়ক হবে। উদাহরণস্বরূপ, মেট্রো শহরে HRA বেসিক বেতনের ২৭%, যা বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে আরও বাড়বে।
৪. চিকিৎসা সুবিধা: মহিলা কর্মীদের জন্য স্বাস্থ্য সুবিধা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৩৪তম SCOVA (Standing Committee of Voluntary Agencies) বৈঠকে পেনশনভোগীদের জন্য ফিক্সড মেডিকেল অ্যালাউন্স (FMA) মাসিক ১,০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩,০০০ টাকা করার প্রস্তাব পাস হয়েছে। মহিলা পেনশনভোগী এবং কর্মরত মহিলা কর্মীদের জন্য এই বৃদ্ধি চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে সহায়ক হবে। এছাড়াও, সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট হেলথ স্কিম (CGHS) সাবস্ক্রিপশন হার বেতন স্ল্যাবের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে এই সুবিধাও উন্নত হবে।
মহিলা কর্মীদের জন্য বিশেষ বিবেচনা
অষ্টম বেতন কমিশন মহিলা কর্মীদের জন্য কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং সমতার উপর জোর দেবে। সরকারি চাকরিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধির জন্য ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যেমন যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর নীতি এবং মহিলা-বান্ধব কর্মক্ষেত্র গঠন। এই কমিশন এই ধরনের নীতিগুলিকে আরও শক্তিশালী করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মহিলা কর্মীদের জন্য ট্রান্সপোর্ট অ্যালাউন্স বৃদ্ধি বা নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থার প্রস্তাব থাকতে পারে। এছাড়া, মহিলা কর্মীদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং পদোন্নতির সুযোগ বাড়ানোর জন্য নতুন নীতি প্রবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে।
পেনশন এবং অবসর-পরবর্তী সুবিধা
অষ্টম বেতন কমিশন মহিলা পেনশনভোগীদের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন নিয়ে আসবে। সপ্তম বেতন কমিশনে ন্যূনতম পেনশন ৩,৫০০ টাকা থেকে বেড়ে ৯,০০০ টাকা হয়েছিল। নতুন ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬ হলে ন্যূনতম পেনশন ২৫,৭৪০ টাকায় উন্নীত হতে পারে। এছাড়া, ইউনিফাইড পেনশন স্কিম (UPS) ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে কার্যকর হবে, যা অবসরের আগের ১২ মাসের বেতনের ভিত্তিতে পেনশন গণনা করবে। এই স্কিম মহিলা পেনশনভোগীদের জন্য অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে।
চ্যালেঞ্জ এবং প্রত্যাশা
যদিও অষ্টম বেতন কমিশন মহিলা কর্মীদের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে আশা করা হচ্ছে, তবে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কমিশনের সুপারিশগুলি চূড়ান্ত করতে এবং বাস্তবায়ন করতে ১৮-২৪ মাস সময় লাগতে পারে, যা ২০২৬ সালের জানুয়ারির সময়সীমা পিছিয়ে দিতে পারে। এছাড়া, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে ফিটমেন্ট ফ্যাক্টর ২.৮৬-এর পরিবর্তে ২.৫-২.৭-এর মধ্যে থাকতে পারে। তবুও, মহিলা কর্মীদের প্রতিনিধিত্বকারী ইউনিয়নগুলি এই কমিশনের কাছে তাদের দাবি তুলে ধরছে, যাতে মহিলা-নির্দিষ্ট সুবিধাগুলি অগ্রাধিকার পায়।
অষ্টম বেতন কমিশন মহিলা সরকারি কর্মীদের জন্য বেতন বৃদ্ধি, উন্নত ভাতা, প্রসূতি সুবিধা এবং পেন BIPOC কর্মীদের জন্য বিশেষভাবে তাৎপর্যপূর্ণ হবে। এই কমিশন মহিলা কর্মীদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং কাজ-জীবনের ভারসাম্য নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যদিও চূড়ান্ত সুপারিশ এখনও ঘোষণা করা হয়নি, তবে এই কমিশন মহিলা কর্মীদের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে।