আয়ুর্বেদিক চাষের জন্য জৈব সার্টিফিকেশন কি প্রয়োজনীয়?

ভারতের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা পদ্ধতি আয়ুর্বেদের জনপ্রিয়তা বিশ্বজুড়ে ক্রমশ বাড়ছে। আয়ুর্বেদিক ঔষধি গাছ এবং এর পণ্যগুলির চাহিদা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে,…

Is Organic Farming Certificate Essential for Ayurvedic Produce Selling in India?

ভারতের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা পদ্ধতি আয়ুর্বেদের জনপ্রিয়তা বিশ্বজুড়ে ক্রমশ বাড়ছে। আয়ুর্বেদিক ঔষধি গাছ এবং এর পণ্যগুলির চাহিদা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে, কৃষক এবং উৎপাদকদের মধ্যে একটি সাধারণ প্রশ্ন উঠে আসছে—আয়ুর্বেদিক চাষ এবং এর পণ্য বিক্রির জন্য জৈব সার্টিফিকেশন বা অর্গানিক ফার্মিং সার্টিফিকেট (Organic Farming Certificate) কি অপরিহার্য? এই প্রতিবেদনে আমরা এই বিষয়টির বিস্তারিত আলোচনা করব এবং জৈব সার্টিফিকেশনের প্রয়োজনীয়তা, এর সুবিধা এবং ভারতীয় প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব বিশ্লেষণ করব।

জৈব সার্টিফিকেশন কী?
জৈব সার্টিফিকেশন হলো এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে কৃষক বা উৎপাদকের চাষ পদ্ধতি এবং উৎপাদিত পণ্য জৈব মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কিনা তা যাচাই করা হয়। ভারতে, জৈব সার্টিফিকেশন নিয়ন্ত্রণ করে ন্যাশনাল প্রোগ্রাম ফর অর্গানিক প্রোডাকশন (NPOP), যা কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্য পণ্য রপ্তানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (APEDA) দ্বারা পরিচালিত হয়। এই প্রোগ্রামের অধীনে, জৈব চাষের জন্য নির্দিষ্ট মানদণ্ড মেনে চলতে হয়, যেমন রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ, জৈব সার ব্যবহার, এবং জমির তিন বছরের রূপান্তরকাল (ট্রানজিশন পিরিয়ড) পালন।

   

আয়ুর্বেদিক চাষের ক্ষেত্রে, যেমন অশ্বগন্ধা, তুলসী, শতাবরী, বা অলোভেরার মতো ঔষধি গাছের চাষ, জৈব সার্টিফিকেশন গ্রাহকদের কাছে পণ্যের গুণমান এবং বিশুদ্ধতার নিশ্চয়তা প্রদান করে। এটি পণ্যের বাজার মূল্য বাড়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানির জন্য গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করে।

আয়ুর্বেদিক পণ্য বিক্রির জন্য সার্টিফিকেশন কি বাধ্যতামূলক?
ভারতের প্রেক্ষাপটে, আয়ুর্বেদিক পণ্য বিক্রির জন্য জৈব সার্টিফিকেশন বাধ্যতামূলক নয়, বিশেষ করে যদি কৃষক বা উৎপাদক স্থানীয় বাজারে সরাসরি বিক্রি করেন এবং তাদের বার্ষিক বিক্রি ৫,০০০ ডলারের (প্রায় ৪ লাখ টাকা) নিচে থাকে। এই ক্ষেত্রে, কৃষকরা তাদের পণ্যকে “জৈব” হিসেবে প্রচার করতে পারেন, তবে তারা “ইন্ডিয়া অর্গানিক” লোগো বা USDA, EU বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক সার্টিফিকেশন লোগো ব্যবহার করতে পারবেন না।

তবে, যদি আয়ুর্বেদিক পণ্য রপ্তানি করা হয় বা বড় বাজারে বিক্রি করা হয়, যেমন সুপারমার্কেট, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, বা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির কাছে, তাহলে জৈব সার্টিফিকেশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। NPOP মানদণ্ড অনুযায়ী সার্টিফিকেশন পাওয়া পণ্যগুলি “ইন্ডিয়া অর্গানিক” লোগো ব্যবহার করতে পারে, যা গ্রাহকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করে।

জৈব সার্টিফিকেশনের প্রক্রিয়া
জৈব সার্টিফিকেশন পাওয়ার জন্য কৃষক বা উৎপাদককে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলি অনুসরণ করতে হয়:

১. আবেদন জমা: কৃষককে APEDA-এর অধীনে স্বীকৃত সার্টিফিকেশন সংস্থার কাছে আবেদন করতে হয়। এই আবেদনে জৈব উৎপাদন পরিকল্পনা, জমির তিন বছরের ইতিহাস, এবং ব্যবহৃত উপকরণের তালিকা জমা দিতে হয়।
২. নথিপত্র যাচাই: সার্টিফিকেশন সংস্থা আবেদনকারীর নথিপত্র পরীক্ষা করে এবং NPOP মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য আছে কিনা তা যাচাই করে।
৩. মাঠ পরিদর্শন: পরিদর্শকরা খামারে গিয়ে মাটি, পানি, বীজ, এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া পরীক্ষা করেন। নিষিদ্ধ পদার্থের (যেমন রাসায়নিক সার বা কীটনাশক) ব্যবহার না হয়েছে তা নিশ্চিত করা হয়।
৪. নমুনা পরীক্ষা: প্রয়োজনে মাটি, পানি, বা উৎপাদিত পণ্যের নমুনা NABL-স্বীকৃত ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করা হয়।
৫. সার্টিফিকেশন প্রদান: সমস্ত মানদণ্ড পূরণ হলে, কৃষককে জৈব সার্টিফিকেশন প্রদান করা হয়, যা তিন বছরের জন্য বৈধ থাকে। এরপর বার্ষিক পরিদর্শনের মাধ্যমে সার্টিফিকেশন নবায়ন করতে হয়।

Advertisements

আয়ুর্বেদিক চাষের ক্ষেত্রে, এই প্রক্রিয়া বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ঔষধি গাছের গুণমান এবং বিশুদ্ধতা চিকিৎসার কার্যকারিতার উপর সরাসরি প্রভাব ফেলে।

সার্টিফিকেশনের সুবিধা
১. বাজার মূল্য বৃদ্ধি: জৈব সার্টিফিকেশনপ্রাপ্ত আয়ুর্বেদিক পণ্যগুলি প্রিমিয়াম মূল্যে বিক্রি হয়। উদাহরণস্বরূপ, জৈব অশ্বগন্ধা বা তুলসীর দাম সাধারণ পণ্যের তুলনায় ২০-৫০% বেশি হতে পারে।
২. আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ: ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এবং সুইজারল্যান্ডের মতো দেশে রপ্তানির জন্য NPOP সার্টিফিকেশন বাধ্যতামূলক। এই সার্টিফিকেশন ইউরোপীয় এবং সুইস মানদণ্ডের সমতুল্য হিসেবে স্বীকৃত।
৩. গ্রাহকদের আস্থা: “ইন্ডিয়া অর্গানিক” লোগো গ্রাহকদের মধ্যে বিশ্বাস তৈরি করে এবং পণ্যের বিশুদ্ধতার নিশ্চয়তা দেয়।
৪. পরিবেশগত সুবিধা: জৈব চাষ মাটির উর্বরতা বজায় রাখে, জল দূষণ কমায়, এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সহায়তা করে।

চ্যালেঞ্জ এবং বিবেচনা
জৈব সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ হতে পারে। আবেদন ফি, পরিদর্শন ফি, এবং নমুনা পরীক্ষার খরচ মিলিয়ে ছোট কৃষকদের জন্য এটি একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে। তবে, সরকারের জৈব কৃষি প্রকল্প এবং জাতীয় মিশন ফর সাসটেইনেবল এগ্রিকালচার (NMSA) এর মাধ্যমে ভর্তুকি এবং আর্থিক সহায়তা পাওয়া যায়। এছাড়াও, তিন বছরের রূপান্তরকালের সময় পণ্যকে জৈব হিসেবে বিক্রি করা যায় না, যা কৃষকদের জন্য আর্থিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো সঠিক রেকর্ড রাখা। NPOP মানদণ্ড অনুযায়ী, কৃষকদের সমস্ত উৎপাদন প্রক্রিয়া, ব্যবহৃত উপকরণ, এবং বিক্রয়ের রেকর্ড পাঁচ বছরের জন্য সংরক্ষণ করতে হয়। এই প্রক্রিয়া ছোট কৃষকদের জন্য জটিল হতে পারে, তবে স্থানীয় কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র এবং এনজিওগুলি এই ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদান করে।

স্থানীয় বাজারে বিক্রির ক্ষেত্রে
যদি কৃষক স্থানীয় বাজারে বা সরাসরি গ্রাহকদের কাছে আয়ুর্বেদিক পণ্য বিক্রি করেন, তাহলে জৈব সার্টিফিকেশন ছাড়াই পণ্যকে “ন্যাচারাল” বা “কেমিক্যাল-মুক্ত” হিসেবে প্রচার করা যেতে পারে। তবে, এই ক্ষেত্রে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করা কঠিন হতে পারে, কারণ সার্টিফিকেশন ছাড়া পণ্যের বিশুদ্ধতা যাচাইয়ের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া থাকে না।

আয়ুর্বেদিক চাষের জন্য জৈব সার্টিফিকেশন বাধ্যতামূলক না হলেও, এটি পণ্যের বাজার মূল্য, গ্রাহকদের আস্থা, এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে বড় আকারে বা রপ্তানির জন্য আয়ুর্বেদিক পণ্য উৎপাদন ও বিক্রির ক্ষেত্রে NPOP সার্টিফিকেশন অপরিহার্য। তবে, ছোট কৃষকদের জন্য খরচ এবং জটিল প্রক্রিয়া একটি বাধা হতে পারে। সরকারি ভর্তুকি এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। আয়ুর্বেদিক পণ্যের ক্রমবর্ধমান চাহিদার প্রেক্ষাপটে, জৈব সার্টিফিকেশন কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক এবং টেকসই পথ হিসেবে কাজ করতে পারে।