পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলা, যা তার সমৃদ্ধ কৃষি ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত, এখন আধুনিক প্রযুক্তির দ্বারা রূপান্তরিত হচ্ছে। ড্রোন প্রযুক্তির ব্যবহার, বিশেষ করে কৃষিতে সার এবং কীটনাশক স্প্রে (Drone Spraying) করার জন্য, নদীয়ার কৃষকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘নমো ড্রোন দিদি’ প্রকল্পের অধীনে নারী স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলি (SHGs) ড্রোন পাইলট হিসেবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, যা কৃষি খাতে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করছে। তবে, এই প্রযুক্তি তার সঙ্গে বেশ কিছু সুবিধা এবং চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। এই প্রতিবেদনে আমরা নদীয়া জেলায় ড্রোন স্প্রে প্রযুক্তির সুবিধা, চ্যালেঞ্জ এবং এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।
ড্রোন স্প্রে প্রযুক্তির সুবিধা
১. সময় ও শ্রম সাশ্রয়: ড্রোন স্প্রে প্রযুক্তি কৃষকদের জন্য সময় এবং শ্রম সাশ্রয়ের একটি বড় হাতিয়ার। ঐতিহ্যগত পদ্ধতিতে এক একর জমিতে কীটনাশক বা সার স্প্রে করতে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগতো, যেখানে ড্রোন এই কাজ মাত্র ১৫ মিনিটে সম্পন্ন করতে পারে। নদীয়ার ধান, পাট এবং সবজি চাষের জন্য এই প্রযুক্তি বিশেষভাবে কার্যকর। উদাহরণস্বরূপ, তামিলনাড়ুর কৃষকরা জানিয়েছেন যে ড্রোন ব্যবহারে এক একর জমিতে স্প্রে করতে মাত্র পাঁচ মিনিট সময় লাগে, যা খরচ অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে।
২. জল ও রাসায়নিক সাশ্রয়: ড্রোন প্রযুক্তি নির্ভুলভাবে স্প্রে করার ক্ষমতা রাখে, যা জল এবং কীটনাশকের ব্যবহার কমায়। যেমন, কেরলের কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রে (KVK) দেখানো হয়েছে যে, ড্রোন ব্যবহারে ১ হেক্টর জমিতে মাত্র ৩৩.৬ লিটার জল দিয়ে সার স্প্রে করা সম্ভব, যেখানে ঐতিহ্যগত পদ্ধতিতে ২৫০-৩০০ লিটার জল প্রয়োজন। এটি নদীয়ার কৃষকদের জন্য জল সংরক্ষণ এবং খরচ কমানোর একটি বড় সুযোগ।
৩. শ্রমিক ঘাটতি সমাধান: নদীয়া জেলায় শ্রমিক ঘাটতি একটি বড় সমস্যা, বিশেষ করে মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি প্রকল্প (MGNREGS) চালু হওয়ার পর। ড্রোন প্রযুক্তি এই সমস্যার সমাধান করছে। তামিলনাড়ুর উদাহরণে দেখা গেছে, ড্রোন শ্রমিকদের বিষাক্ত রাসায়নিকের সংস্পর্শ থেকে রক্ষা করে এবং কাজের দক্ষতা বাড়ায়। নদীয়ার কৃষকরাও এই প্রযুক্তির মাধ্যমে শ্রমিক ঘাটতির সমস্যা মোকাবেলা করতে পারছেন।
৪. নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুবিধা: ঐতিহ্যগত পদ্ধতিতে কীটনাশক স্প্রে করার সময় কৃষক এবং শ্রমিকরা বিষাক্ত রাসায়নিকের সংস্পর্শে আসেন, যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ড্রোন ব্যবহারে এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমে যায়। নদীয়ার কৃষকরা এই প্রযুক্তির মাধ্যমে নিরাপদে কাজ করতে পারছেন।
৫. আর্থিক লাভ: ড্রোন ব্যবহারে উৎপাদন খরচ ৪০-৫০% কমে যায়, কারণ জল, কীটনাশক এবং শ্রমের খরচ কমে। তেলেঙ্গানার একজন কৃষক জানিয়েছেন, ড্রোন ব্যবহারে তিনি তার সারের খরচ ৪০% কমিয়েছেন। নদীয়ার কৃষকরাও এই প্রযুক্তির মাধ্যমে লাভবান হতে পারেন।
ড্রোন স্প্রে প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ
১. নিয়ন্ত্রণ ও আইনি জটিলতা: ভারতে কীটনাশক স্প্রে করার জন্য ড্রোন ব্যবহার ২০২০ সাল পর্যন্ত অবৈধ ছিল। কেন্দ্রীয় কীটনাশক বোর্ড (CIB) থেকে অনুমোদন ছাড়া এই ধরনের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ। যদিও নমো ড্রোন দিদি প্রকল্পের মাধ্যমে এই নিয়ম কিছুটা শিথিল হয়েছে, তবুও নদীয়ার কৃষকদের জন্য এই প্রক্রিয়া জটিল। অনেক কৃষক এখনও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে অবগত নন।
২. উচ্চ প্রাথমিক বিনিয়োগ: ড্রোন ক্রয় এবং রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অনেক কৃষকের জন্য বড় বাধা। কলকাতার একটি সংস্থা জানিয়েছে, একটি কৃষি ড্রোনের দাম ২,৬০,০০০ টাকা, যা নদীয়ার ক্ষুদ্র ও মাঝারি কৃষকদের জন্য ব্যয়বহুল। যদিও সরকার ৮০% পর্যন্ত সাবসিডি দিচ্ছে, তবুও বাকি খরচ মেটানো অনেকের জন্য কঠিন।
৩. প্রশিক্ষণের অভাব: ড্রোন পরিচালনার জন্য দক্ষতা প্রয়োজন, এবং নদীয়ার অনেক কৃষক এবং নারী স্বনির্ভর গোষ্ঠীর সদস্যরা এই প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত। তামিলনাড়ুতে ৪৪টি স্বনির্ভর গোষ্ঠী ড্রোন পেয়েছে, কিন্তু নদীয়ায় এই প্রকল্প এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। প্রশিক্ষণের অভাবে অনেকে এই প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে পড়ছেন।
৪. পরিবেশগত উদ্বেগ: ড্রোন স্প্রে প্রযুক্তি পরিবেশের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, তামিলনাড়ুর বেদানথাঙ্গল পাখির অভয়ারণ্যের কাছে ড্রোন ব্যবহারে পাখিদের উপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। নদীয়ার কৃষি অঞ্চলগুলিতে, যেখানে জলাভূমি এবং জৈব বৈচিত্র্য রয়েছে, ড্রোনের অতিরিক্ত ব্যবহার পরিবেশের ক্ষতি করতে পারে।
৫. সামাজিক ও নিরাপত্তা উদ্বেগ: সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে অজ্ঞাত ড্রোন দেখা যাওয়ায় নিরাপত্তা উদ্বেগ বেড়েছে। নদীয়ার কৃষকদের মধ্যে এই প্রযুক্তি নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে, এবং অনেকে ড্রোনের ব্যবহারে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। এছাড়া, স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এই প্রযুক্তি গ্রহণে প্রতিরোধও দেখা যাচ্ছে।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
নদীয়ায় ড্রোন স্প্রে প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল, তবে এর সফল বাস্তবায়নের জন্য কিছু পদক্ষেপ প্রয়োজন। প্রথমত, কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। দ্বিতীয়ত, সরকারি সাবসিডি এবং সহজ ঋণ সুবিধা বাড়াতে হবে। তৃতীয়ত, পরিবেশগত প্রভাব নিয়ন্ত্রণের জন্য নীতিমালা তৈরি করা প্রয়োজন। নমো ড্রোন দিদি প্রকল্পের মাধ্যমে নারী কৃষকদের ক্ষমতায়ন করা হচ্ছে, যা নদীয়ার কৃষি অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করবে।
নদীয়া জেলায় ড্রোন স্প্রে প্রযুক্তি কৃষিতে একটি নতুন যুগের সূচনা করছে। এটি সময়, শ্রম এবং খরচ সাশ্রয়ের পাশাপাশি নিরাপত্তা ও দক্ষতা বাড়াচ্ছে। তবে, আইনি জটিলতা, উচ্চ বিনিয়োগ, প্রশিক্ষণের অভাব এবং পরিবেশগত উদ্বেগ এই প্রযুক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার, কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের সমন্বিত প্রচেষ্টায় নদীয়ার কৃষকরা এই প্রযুক্তির পূর্ণ সুবিধা নিতে পারবেন। এই প্রযুক্তি কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি নদীয়ার অর্থনীতি ও জীবিকাকে সমৃদ্ধ করতে পারে।