ভারতের টেস্ট দলের সহ-অধিনায়ক এবং উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান ঋষভ পন্থ (Rishabh Pant) ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে চলমান পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজে ব্যাটিংয়ের সময় নিজের সাথে কথা বলার অভ্যাস নিয়ে মুখ খুলেছেন। এই সিরিজে তিনি একাধিকবার স্টাম্প মাইকের মাধ্যমে নিজের সাথে কথা বলতে শোনা গেছেন, যা সমর্থক এবং ক্রিকেট বিশ্লেষকদের মধ্যে আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। লর্ডসে তৃতীয় টেস্টের প্রাক্কালে এক সাংবাদিক সম্মেলনে পন্থকে এই অভ্যাস সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, এটি তার শৈশব থেকে চলে আসা একটি অভ্যাস। তিনি বলেন, “আমি সবসময় নিজের সাথে কথা বলি। স্টাম্প মাইকের কারণে এখন সবাই এটা শুনতে পাচ্ছে। আমার প্রয়াত কোচ তারক সিনহা আমাকে শিখিয়েছিলেন যে নিজের সাথে কথা বলতে হবে। এটা আমি ছোটবেলা থেকেই করে আসছি, এবং এটা আমাকে অনেক সাহায্য করে।”
এই প্রতিবেদনে পন্থের এই অনন্য অভ্যাস, তার পিছনের কারণ এবং এই সিরিজে তার পারফরম্যান্স নিয়ে আলোচনা করব। এছাড়াও, তিনি জোফরা আর্চারের প্রত্যাবর্তন এবং ভারতের দল গঠন নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তাও এখানে তুলে ধরা হবে।
নিজের সাথে কথা বলার অভ্যাস
ঋষভ পন্থের ব্যাটিং স্টাইল সবসময়ই আক্রমণাত্মক এবং অপ্রচলিত। তবে, তিনি যখন ব্যাট করেন, তখন তার নিজের সাথে কথা বলার অভ্যাস দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। হেডিংলেতে প্রথম টেস্টে তিনি দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি (১৩৪ এবং ১১৮) করেন, এবং এই সময় স্টাম্প মাইকে তার কথোপকথন ধরা পড়ে। উদাহরণস্বরূপ, একটি মুহূর্তে তিনি নিজেকে বলতে শোনা যায়, “তুই এমন কেন করছিস, এর কী দরকার?” এই ধরনের মন্তব্য শুধুমাত্র হাস্যকরই নয়, বরং তার মানসিক প্রক্রিয়া এবং খেলার প্রতি তার নিবিষ্টতার প্রতিফলন।
পন্থ জানান, এই অভ্যাস তিনি তার প্রয়াত কোচ তারক সিনহার কাছ থেকে শিখেছেন। তিনি বলেন, “আমার কোচ আমাকে বলেছিলেন যে নিজের সাথে কথা বলা মনকে কেন্দ্রীভূত রাখতে সাহায্য করে। এটা আমাকে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।” ভারতের ব্যাটিং কোচ সীতাংশু কোটকও এই বিষয়ে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, “ঋষভ ব্যাটিংয়ের সময় বেশি কথা বলতে পছন্দ করেন না, কারণ তিনি মনে করেন এটি তার মানসিকতাকে প্রভাবিত করে এবং ভুল সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যেতে পারে। তবে, মাঠের বাইরে তিনি খেলা এবং অন্য ব্যাটসম্যানদের নিয়ে অনেক আলোচনা করেন।”
ইংল্যান্ড সিরিজে পন্থের পারফরম্যান্স
ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে চলমান টেস্ট সিরিজে পন্থ অসাধারণ ফর্মে রয়েছেন। হেডিংলেতে প্রথম টেস্টে তিনি দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করেন, যা ভারতীয় উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যানদের মধ্যে প্রথম। এছাড়া, এডবাস্টনে দ্বিতীয় টেস্টে তিনি ৫৮ বলে ৬৫ রানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলেন, যা ভারতের ৩৩৬ রানের জয়ে বড় ভূমিকা রাখে। তার মোট ৩৪২ রান এই সিরিজে ৮৫.৫০ গড়ে এবং ৮১.৮১ স্ট্রাইক রেটে এসেছে, যা তাকে দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় করে তুলেছে।
পন্থের এই পারফরম্যান্স তার পরিকল্পনা এবং মানসিক শক্তির প্রমাণ। তিনি বলেন, “আমি একটি বলের পর একটি বল খেলার চেষ্টা করি। আমার মনে একটি পরিষ্কার পরিকল্পনা থাকে, এবং আমি জানি প্রতিপক্ষ দল আমাকে কী করতে চায়। তবে, নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী খেলতে হয়।” এই সিরিজে তার আক্রমণাত্মক ব্যাটিং শৈলী ইংল্যান্ডের বোলারদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জোফরা আর্চারের প্রত্যাবর্তন নিয়ে মন্তব্য
লর্ডসে তৃতীয় টেস্টে ইংল্যান্ডের পেসার জোফরা আর্চারের প্রত্যাবর্তন নিয়েও পন্থ মন্তব্য করেছেন। আর্চার চার বছরের বেশি সময় পর টেস্ট ক্রিকেটে ফিরছেন, এবং এটি ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হতে পারে। পন্থ বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে মাঠে নামার সময় আমার খেলা উপভোগ করি এবং ২০০% দিতে চাই। জোফরা আর্চারের ফিরে আসা একটি ভালো প্রতিযোগিতা হবে, কারণ তিনিও দীর্ঘ বিরতির পর ফিরছেন। আমি তার জন্য খুশি।” এই মন্তব্য থেকে পন্থের আত্মবিশ্বাস এবং প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব স্পষ্ট হয়।
দলের সম্ভাব্য গঠন নিয়ে আলোচনা
তৃতীয় টেস্টের জন্য ভারতের দল গঠন নিয়ে পন্থ জানান, পিচের অবস্থার উপর নির্ভর করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তিনি বলেন, “আলোচনা চলছে। আমরা পিচের অবস্থা দেখে সিদ্ধান্ত নেব। কখনও কখনও পিচের রঙ এবং আর্দ্রতা দুই দিনে বদলে যায়। তাই আমাদের দেখতে হবে পিচ কীভাবে খেলবে।” ভারতের সম্ভাব্য একাদশে তিনজন পেসার এবং একজন স্পিনার বা তিনজন পেসার এবং দুজন স্পিনারের সমন্বয় হতে পারে। এই সিদ্ধান্তে রবীন্দ্র জাডেজা এবং কুলদীপ যাদবের মতো খেলোয়াড়দের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে।
পন্থের ক্রিকেটীয় যাত্রা
ঋষভ পন্থের ক্রিকেটীয় যাত্রা অনুপ্রেরণাদায়ক। ২০১৬ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে তার ব্যাটিং দক্ষতা তাকে আলোচনায় নিয়ে আসে। এরপর তিনি আইপিএল-এ দিল্লি ক্যাপিটালসের হয়ে খেলেন এবং ২০১৮ সালে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষেক করেন। ২০২২ সালে একটি ভয়াবহ গাড়ি দুর্ঘটনার পর তিনি দীর্ঘ সময়ের জন্য মাঠের বাইরে ছিলেন। তবে, তার প্রত্যাবর্তন অসাধারণ। ২০২৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তিনি ভারতের শিরোপা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
এই সিরিজে পন্থের পারফরম্যান্স ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। তিনি শুধুমাত্র ব্যাটিংয়ে নয়, উইকেটকিপিংয়েও দলের জন্য মূল্যবান। তার স্টাম্পের পিছন থেকে কথোপকথন এবং ব্যাটিংয়ের সময় নিজের সাথে কথা বলা তার খেলার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই অভ্যাস তাকে মানসিকভাবে শক্তিশালী রাখে এবং তার খেলায় স্থিরতা আনে।
ঋষভ পন্থের নিজের সাথে কথা বলার অভ্যাস তার ক্রিকেটীয় দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি তার প্রয়াত কোচ তারক সিনহার শিক্ষার ফল, যিনি তাকে মানসিকভাবে কেন্দ্রীভূত থাকতে শিখিয়েছিলেন। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে চলমান সিরিজে তার পারফরম্যান্স এবং মানসিক শক্তি ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য একটি বড় সম্পদ। লর্ডসে তৃতীয় টেস্টে তার ব্যাটিং এবং স্টাম্প মাইকের কথোপকথন নিঃসন্দেহে সমর্থকদের জন্য আরও আকর্ষণীয় মুহূর্ত উপহার দেবে।