ভারতের কৃষি খাতে ঔষধি গাছের (Medicinal Plant) চাষ একটি ক্রমবর্ধমান এবং লাভজনক ক্ষেত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ঔষধি এবং সুগন্ধি গাছ (Medicinal and Aromatic Plants – MAPs) চাষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং এর স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সুবিধার কারণে কেন্দ্রীয় সরকার এই খাতে কৃষকদের উৎসাহিত করতে বিভিন্ন ভর্তুকি এবং প্রকল্প চালু করেছে। জাতীয় ঔষধি উদ্ভিদ বোর্ড (National Medicinal Plants Board – NMPB), আয়ুষ মন্ত্রণালয়ের অধীনে, ঔষধি গাছ চাষের প্রচার এবং সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০২৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের ভর্তুকি এবং প্রকল্পগুলি কৃষকদের জন্য এই খাতে প্রবেশের একটি সুবর্ণ সুযোগ প্রদান করছে। এই প্রতিবেদনে আমরা ২০২৫ সালে ঔষধি গাছ চাষের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ভর্তুকি এবং প্রকল্পগুলির বিস্তারিত আলোচনা করব।
কেন্দ্রীয় সরকারের ভর্তুকি প্রকল্প
কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ুষ মন্ত্রণালয়ের অধীনে National Medicinal Plants Board (NMPB) ২০০৮ সাল থেকে “জাতীয় ঔষধি উদ্ভিদ মিশন” (National Mission on Medicinal Plants – NMMP) এবং “জাতীয় আয়ুষ মিশন” (National AYUSH Mission – NAM) এর মাধ্যমে ঔষধি গাছ চাষের জন্য ভর্তুকি প্রদান করছে। ২০২১-২৬ সময়কালের জন্য “ঔষধি উদ্ভিদের সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং টেকসই ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় খাত প্রকল্প” (Central Sector Scheme for Conservation, Development, and Sustainable Management of Medicinal Plants) এর জন্য ৩২২.৪১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য হল কৃষকদের ঔষধি গাছ চাষে উৎসাহিত করা, ফসলের বৈচিত্র্যকরণ প্রচার করা এবং আয়ুষ শিল্পের জন্য কাঁচামালের গুণমান নিশ্চিত করা।
ভর্তুকির পরিমাণ এবং যোগ্যতা
এনএমপিবি-র মাধ্যমে কৃষকদের চাষের খরচের ৩০%, ৫০% এবং ৭৫% পর্যন্ত ভর্তুকি প্রদান করা হয়, যা নির্দিষ্ট ঔষধি উদ্ভিদের প্রজাতির উপর নির্ভর করে। উদাহরণস্বরূপ:
- ৭৫% ভর্তুকি: জটামাংসি, গুগ্গলের মতো অত্যন্ত বিপন্ন প্রজাতির জন্য।
- ৫০% ভর্তুকি: সর্পগন্ধা, সীবাকথর্নের মতো প্রজাতির জন্য, যেগুলির সরবরাহ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
- ৩০% ভর্তুকি: পিপ্পলি, মঞ্জিষ্ঠার মতো অন্যান্য ঔষধি উদ্ভিদের জন্য।
এই ভর্তুকিগুলি কৃষকদের জমিতে ১৪০টি অগ্রাধিকার প্রাপ্ত ঔষধি উদ্ভিদের চাষের জন্য প্রদান করা হয়। ২০১৫-২১ সময়কালে, আয়ুষ মন্ত্রণালয় ৫৯,৩৫০ জন কৃষককে ৫৬,৩০৫ হেক্টর জমিতে ৮৪টি ঔষধি প্রজাতির চাষের জন্য সহায়তা করেছে। উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং পার্বত্য রাজ্যগুলিতে (যেমন হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, জম্মু ও কাশ্মীর) ভর্তুকির অনুপাত ৯০:১০, অন্য রাজ্যগুলিতে ৬০:৪০ অনুপাতে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে ভাগ করা হয়।
প্রধান প্রকল্প এবং সুবিধা
১. জাতীয় আয়ুষ মিশন (NAM): এই প্রকল্পের অধীনে, কৃষকদের জন্য ভর্তুকি ছাড়াও নার্সারি স্থাপন, মাটি ও জল পরীক্ষণ, এবং ফসল কাটার পরে ব্যবস্থাপনার জন্য সহায়তা প্রদান করা হয়। এটি ক্লাস্টার-ভিত্তিক চাষকে উৎসাহিত করে এবং রাজ্য কৃষি বা উদ্যানপালন বিভাগের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়।
২. আত্ম নির্ভর ভারত প্যাকেজ: ২০২০ সালে, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন ঘোষণা করেছিলেন যে ঔষধি গাছ চাষের প্রচারের জন্য ৪০০০ কোটি টাকার প্যাকেজ বরাদ্দ করা হয়েছে। এই তহবিল ঔষধি গাছের বাজারজাতকরণ এবং প্রক্রিয়াকরণের জন্য অবকাঠামো উন্নয়নেও ব্যবহৃত হচ্ছে।
৩. ই-চারক প্ল্যাটফর্ম: এই প্ল্যাটফর্ম কৃষক, ব্যবসায়ী এবং স্থানীয় নিরাময়কারীদের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এটি ২৫টি ভেষজ বাজার থেকে ১০০টি ঔষধি উদ্ভিদের বাজার মূল্য প্রতি পাক্ষিক প্রকাশ করে।
৪. গুণমান শংসাপত্র: কোয়ালিটি কাউন্সিল অফ ইন্ডিয়া (QCI) দ্বারা প্রদত্ত ভলান্টারি সার্টিফিকেশন স্কিম ফর মেডিসিনাল প্ল্যান্ট প্রোডিউস (VCSMPP) কৃষকদের পণ্যের গুণমান এবং টেকসই চাষের জন্য স্বীকৃতি দেয়, যা বাজারে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ায়।
কৃষকদের জন্য সুবিধা
ঔষধি গাছ চাষ কৃষকদের জন্য একটি বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে কাজ করে। এটি ফসলের বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে ঝুঁকি কমায় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ, রাজস্থানে ঔষধি গাছ চাষে সবচেয়ে বেশি জমি ব্যবহৃত হয়, এবং এই রাজ্যে কৃষকরা উল্লেখযোগ্য আর্থিক সুবিধা পাচ্ছেন। এছাড়া, কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ, মেলা, এবং প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হয়, যা তাদের চাষের কৌশল উন্নত করতে সহায়তা করে।
চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
ঔষধি গাছ চাষে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন বাজার সংযোগের অভাব, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, এবং কাঁচামালের দামের অস্থিরতা। এনএমপিবি এই সমস্যাগুলি মোকাবিলায় কৃষকদের জন্য প্রক্রিয়াকরণ ক্লাস্টার, গুদামজাতকরণ, এবং বিপণন অবকাঠামো স্থাপন করছে। এছাড়া, কৃষক কল সেন্টার এবং কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের (KVK) সাথে একীকরণ কৃষকদের তথ্য এবং সহায়তা প্রদান করছে।
২০২৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের ভর্তুকি এবং প্রকল্পগুলি ঔষধি গাছ চাষকে ভারতের কৃষকদের জন্য একটি লাভজনক বিকল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। ৩০% থেকে ৭৫% ভর্তুকি, প্রশিক্ষণ, এবং বাজার সংযোগের মাধ্যমে কৃষকরা তাদের আয় বাড়াতে পারেন এবং ফসলের বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে ঝুঁকি কমাতে পারেন। আয়ুষ মন্ত্রণালয় এবং এনএমপিবি-র উদ্যোগ ভারতকে ঔষধি উদ্ভিদ উৎপাদনে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে। কৃষকদের জন্য এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঔষধি গাছ চাষে নতুন দিগন্ত খোলা সম্ভব।