এনসিআরবি রিপোর্টে কৃষক আত্মহত্যার উদ্বেগজনক তথ্য

ভারত একটি কৃষিপ্রধান দেশ, যেখানে প্রায় ৭০% গ্রামীণ জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। তবে, কৃষকদের জীবনে যে দুর্দশা এবং অর্থনৈতিক চাপ রয়েছে, তা…

Farmer Suicides in India

ভারত একটি কৃষিপ্রধান দেশ, যেখানে প্রায় ৭০% গ্রামীণ জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কৃষির উপর নির্ভরশীল। তবে, কৃষকদের জীবনে যে দুর্দশা এবং অর্থনৈতিক চাপ রয়েছে, তা দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার বিষয়। জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরো (এনসিআরবি) প্রতি বছর দুর্ঘটনা ও আত্মহত্যার (Farmer Suicides) তথ্য প্রকাশ করে, যেখানে কৃষক আত্মহত্যার পরিসংখ্যানও অন্তর্ভুক্ত থাকে। ২০২৫ সালের এনসিআরবি রিপোর্ট এখনও প্রকাশিত হয়নি, তবে ২০২২ সালের সর্বশেষ তথ্য এবং পূর্ববর্তী বছরগুলির প্রবণতার উপর ভিত্তি করে আমরা কৃষক আত্মহত্যার বর্তমান পরিস্থিতি এবং এর কারণগুলি বিশ্লেষণ করতে পারি। এই প্রতিবেদনে আমরা ২০২২ সালের এনসিআরবি তথ্যের আলোকে কৃষক আত্মহত্যার প্রধান কারণ, প্রভাবিত রাজ্য এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে আলোচনা করব।

২০২২ সালের এনসিআরবি রিপোর্ট: একটি ভয়াবহ চিত্র
২০২২ সালের এনসিআরবি রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে কৃষি খাতে জড়িত ১১,২৯০ জন আত্মহত্যা করেছেন, যার মধ্যে ৫,২০৭ জন ছিলেন কৃষক এবং ৬,০৮৩ জন ছিলেন কৃষি শ্রমিক। এটি ২০২১ সালের তুলনায় ৩.৭% বৃদ্ধি পেয়েছে, যখন ১০,২৮১ জনের আত্মহত্যার রিপোর্ট করা হয়েছিল। এই তথ্য থেকে বোঝা যায় যে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে একজন কৃষক বা কৃষি শ্রমিক আত্মহত্যা করছেন। এই পরিসংখ্যান ভারতের কৃষি খাতে গভীর সংকটের ইঙ্গিত দেয়। মহারাষ্ট্রে সর্বাধিক ৪,২৪৮ জন কৃষক ও কৃষি শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন, যা মোট কৃষি আত্মহত্যার ৩৮%। এরপরে রয়েছে কর্নাটক (২,৩৯২), অন্ধ্রপ্রদেশ (৯১৭), তামিলনাড়ু (৭২৮) এবং মধ্যপ্রদেশ (৬৪১)। এই পাঁচটি রাজ্য মোট কৃষি আত্মহত্যার প্রায় ৮০% এবং কৃষক আত্মহত্যার ৮৫% জন্য দায়ী।

   

কৃষক আত্মহত্যার প্রধান কারণ
কৃষক আত্মহত্যার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে, যা অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং পরিবেশগত বিষয়ের সমন্বয়ে গঠিত। এনসিআরবি রিপোর্ট অনুযায়ী, নিম্নলিখিত কারণগুলি প্রধান ভূমিকা পালন করে:

  • ঋণের বোঝা: কৃষকদের মধ্যে ঋণ একটি প্রধান সমস্যা। ব্যাংক এবং ব্যক্তিগত মহাজনদের কাছ থেকে নেওয়া ঋণের চাপ অনেক কৃষককে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, ৩,০০০ কৃষক আত্মহত্যার মধ্যে ২,৪৭৪ জনের ব্যাংক ঋণ ছিল।
  • ফসলের ব্যর্থতা: খরা, বন্যা এবং অপ্রত্যাশিত বৃষ্টির কারণে ফসল নষ্ট হওয়া কৃষকদের আর্থিক ক্ষতির মুখে ফেলে। ২০২২ সালে অনেক রাজ্যে খরা এবং অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে ফসলের ক্ষতি হয়েছিল।
  • ইনপুট খরচ বৃদ্ধি: বীজ, সার, কীটনাশক এবং কৃষি সরঞ্জামের দাম বৃদ্ধি কৃষকদের লাভের পরিমাণ কমিয়ে দেয়।
  • জলবায়ু পরিবর্তন: অনিয়মিত মৌসুম, ফ্ল্যাশ ফ্লাড এবং জলের অভাব কৃষকদের উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস করে।
  • সরকারি নীতি ও সচেতনতার অভাব: সরকারি প্রকল্প যেমন ই-ন্যাশনাল এগ্রিকালচার মার্কেট (eNAM) থাকলেও, অনেক কৃষক এর সুবিধা সম্পর্কে অবগত নন।

কোন রাজ্যগুলি সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত?
মহারাষ্ট্র বহু বছর ধরে কৃষক আত্মহত্যার কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৯৫ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে এই রাজ্যে ৬০,০০০-এর বেশি কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। ২০২২ সালে মহারাষ্ট্রে ৪,২৪৮ জন কৃষক ও কৃষি শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন। কর্নাটক এবং অন্ধ্রপ্রদেশও উচ্চ হারে কৃষক আত্মহত্যার জন্য পরিচিত। উত্তর প্রদেশে ২০২১ থেকে ২০২২ সালে আত্মহত্যার হার ৪২.১৩% বৃদ্ধি পেয়েছে, যা উদ্বেগজনক। তবে, পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ওড়িশা এবং উত্তরাখণ্ডের মতো কিছু রাজ্যে কৃষক আত্মহত্যার কোনও রিপোর্ট নেই, যা তথ্যের সঠিক রিপোর্টিং নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

কৃষি শ্রমিকদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা
একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা হল কৃষি শ্রমিকদের মধ্যে আত্মহত্যার হার কৃষকদের তুলনায় বেশি। ২০২২ সালে ৬,০৮৩ জন কৃষি শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন, যেখানে কৃষকদের সংখ্যা ছিল ৫,২০৭। এটি ইঙ্গিত দেয় যে কৃষি শ্রমিকরা, যারা দৈনিক মজুরির উপর নির্ভরশীল, তারা আরও বেশি অর্থনৈতিক চাপের মুখে রয়েছেন।

Advertisements

সমাধানের পথ
কৃষক আত্মহত্যা রোধে সরকারি এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগের প্রয়োজন। কিছু সম্ভাব্য সমাধান হল:

  • সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প: মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি প্রকল্প (MGNREGS) কৃষকদের জন্য বিকল্প আয়ের উৎস প্রদান করতে পারে।
  • ঋণ সহায়তা: সরকারি ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণ এবং ঋণ মওকুফের প্রকল্প চালু করা।
  • জলবায়ু-সহনশীল কৃষি: খরা এবং বন্যা প্রতিরোধী ফসল এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নতি।
  • মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা: গ্রামীণ এলাকায় মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবা এবং হেল্পলাইন চালু করা।
  • সচেতনতা বৃদ্ধি: কৃষকদের সরকারি প্রকল্প সম্পর্কে সচেতন করতে শিক্ষা ও প্রচারণা।

তথ্যের সীমাবদ্ধতা
এনসিআরবি তথ্যের উপর নির্ভর করা হলেও, এটি প্রায়শই অসম্পূর্ণ বলে সমালোচিত হয়। উদাহরণস্বরূপ, পাঞ্জাবে পরিচালিত একটি বিশ্লেষণে দেখা গেছে যে প্রকৃত আত্মহত্যার সংখ্যা এনসিআরবি তথ্যের তুলনায় প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। এছাড়া, কৃষকদের পাশাপাশি গৃহবধূ হিসেবে কাজ করা মহিলাদের আত্মহত্যা সঠিকভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয় না, যা তথ্যের ঘাটতি সৃষ্টি করে।

ভারতে কৃষক আত্মহত্যা একটি গভীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা। ২০২২ সালের এনসিআরবি তথ্য থেকে স্পষ্ট যে এই সংকট ক্রমাগত বাড়ছে। মহারাষ্ট্র, কর্নাটক এবং অন্ধ্রপ্রদেশের মতো রাজ্যগুলিতে পরিস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। সরকারি নীতি, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং অর্থনৈতিক চাপ এই সমস্যাকে আরও জটিল করেছে। তবে, সঠিক নীতি, সামাজিক সুরক্ষা এবং মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তার মাধ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব। ২০২৫ সালের এনসিআরবি রিপোর্ট প্রকাশিত হলে এই প্রবণতার আরও বিস্তারিত বিশ্লেষণ সম্ভব হবে। তবে, বর্তমান তথ্যই যথেষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে কৃষকদের জীবন রক্ষার জন্য জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন।

[তথ্য সূত্র: জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরো (NCRB), ২০২২]