টিনটিন, কমিকসের মোড়কে রাজনীতি-বর্ণবিদ্বেষের অজানা গল্প

টিনটিন, (Tintin) বেলজিয়ান কার্টুনিস্ট হার্জের(জর্জেস রেমি) সৃষ্ট এই কমিক চরিত্র, গত শতাব্দী থেকে ৮ থেকে ৮০ সকলের মন জয় করেছে। তরুণ সাংবাদিক টিনটিন, তার বিশ্বস্ত…

Tintin untold story behind the comics

টিনটিন, (Tintin) বেলজিয়ান কার্টুনিস্ট হার্জের(জর্জেস রেমি) সৃষ্ট এই কমিক চরিত্র, গত শতাব্দী থেকে ৮ থেকে ৮০ সকলের মন জয় করেছে। তরুণ সাংবাদিক টিনটিন, তার বিশ্বস্ত কুকুর স্নোই এবং বন্ধু ক্যাপ্টেন হ্যাডকের দুঃসাহসিক অভিযানের গল্প ১৩০টি ভাষায় অনূদিত হয়ে বিশ্বজুড়ে ২৬০ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে।

বিশ্বব্যাপি মানুষ শুধু মাত্র মনোরঞ্জনের জন্যই টিনটিনের (Tintin) ভক্ত। কিন্তু এই প্রিয় কমিক সিরিজের পিছনে রয়েছে রাজনৈতিক এজেন্ডা। যা অনেকেরই অজানা। তা ছাড়া এই কমিকস বর্ণবিদ্বেষ এবং সেন্সরশিপের এক অন্ধকার অধ্যায়। আসুন জেনে নিই টিনটিনের কিছু অজানা গল্প।

   

রাজনৈতিক এজেন্ডার জন্ম (Tintin)

১৯২৯ সালে টিনটিনের (Tintin) প্রথম অ্যালবাম ‘টিনটিন ইন দ্য ল্যান্ড অফ দ্য সোভিয়েটস’ প্রকাশিত হয় ক্যাথলিক পত্রিকা লে পেটিট ভিনজিয়েম-এ। এই পত্রিকার সম্পাদক, ফ্যাসিস্টপন্থী পুরোহিত নরবার্ট ওয়ালেজ, হার্জেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাতে নির্দেশ দেন। ফলস্বরূপ, প্রথম অ্যালবামটি কমিউনিজমবিরোধী প্রোপাগান্ডায় পরিপূর্ণ ছিল।

হার্জে নিজে কখনও সোভিয়েত ইউনিয়নে যাননি, তাই গল্পটি তথ্যগত ভুলে ভরা। এরপর ১৯৩১ সালে প্রকাশিত হয় ‘টিনটিন (Tintin) ইন দ্য কঙ্গো।’এই সিরিজ টির ভীত হল বেলজিয়ান ঔপনিবেশিক শাসনের প্রশংসা। তার সাথে আফ্রিকানদের ‘অসভ্য’ ও ‘নিকৃষ্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করা। এই অ্যালবামে টিনটিন এক আফ্রিকান শিশুকে শেখায় যে তার ‘মাতৃভূমি’ বেলজিয়াম, যা ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রতিফলন।

১৯৩২ সালে লেখা ‘টিনটিন (Tintin) ইন আমেরিকা’আমেরিকান পুঁজিবাদ ও ভোগবাদের সমালোচনা করে, যা তৎকালীন বেলজিয়ান সমাজের আমেরিকা বিরোধী মনোভাবকে তুলে ধরে। এই প্রাথমিক অ্যালবামগুলো হার্জের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং পত্রিকার সম্পাদকীয় নির্দেশনার ফল।

বর্ণবিদ্বেষ ও সেন্সরশিপ

‘টিনটিন (Tintin) ইন দ্য কঙ্গো’ বর্ণ বিদ্বেষের জন্য সবচেয়ে বিতর্কিত। এতে কঙ্গোর আদিবাসীদের বানরের মতো চেহারা, মূর্খ এবং অলস হিসেবে দেখানো হয়। এমনকি স্নোই, টিনটিনের কুকুর, তাদের প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে।

এছাড়া, টিনটিন (Tintin) একটি গণ্ডারকে ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দেয়, যা পশুদের প্রতি নৃশংসতার চরম উদাহরণ। এছাড়া উদাহরণ স্বরূপ আরও দেখা যায় টিনটিন লুকোবার জন্য একটি শিম্পাঞ্জি কে গুলি করে মেরে তার চামড়া ছাড়িয়ে পরে নেয়। ঠিক এই কারণ গুলির জন্যই এই কমিক সিরিজটি সেন্সর বোর্ডে পাস হয়নি সেই সময়ে।

২০০৭ সালে আমেরিকায় মানবাধিকার আইনজীবী ডেভিড এনরাইট বিদ্বেষের অভিযোগে এই অ্যালবামটিকে শিশুদের বিভাগ থেকে সরানোর দাবি জানান। ফলস্বরূপ, বর্ডার্স এবং ওয়াটারস্টোনস বইটিকে প্রাপ্তবয়স্ক গ্রাফিক নভেল বিভাগে স্থানান্তর করে।

আমেরিকার ব্রুকলিন পাবলিক লাইব্রেরি এই বই এমন একটি জায়গায় রাখে যেখানে শুধু অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে প্রবেশ করা যায়। সুইডেনে ২০১১ সালে ‘টিনটিন-গেট’ নামে পরিচিত একটি বিতর্কে স্টকহোমের একটি শিশু গ্রন্থাগার থেকে বইটি সরিয়ে ফেলা হয়।

Advertisements

২০০৭ সালে কঙ্গোর ছাত্র (Tintin) বিয়েঁভেনু এমবুতু মন্ডন্ডো বেলজিয়ামে এই অ্যালবাম নিষিদ্ধ করার জন্য মামলা করেন, দাবি করে যে এটি কঙ্গোর মানুষের অপমান এবং ‘শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের’ প্রচার করে। যদিও ২০১২ সালে বেলজিয়ান আদালত নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, তবু বইটির বিক্রি ৪,০০০% বৃদ্ধি পায়। এছাড়া, ‘দ্য শুটিং স্টার’ (১৯৪১) অ্যালবামে ইহুদি চরিত্র ‘ব্লুমেনস্টাইন’-এর ক্যারিকেচার এবং ইহুদিবিরোধী মনোভাব প্রকাশ পায়, যা পরবর্তী সংস্করণে ‘বোলউইঙ্কেল’ নামে পরিবর্তিত হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও হার্জের বিতর্কিত ভূমিকা

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেলজিয়াম জার্মান দখলে ছিল। হার্জে তখন নাজি-নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা লে সোয়ার-এ টিনটিনের (Tintin) গল্প প্রকাশ করেন। এই সময় তিনি রাজনৈতিক থিম এড়িয়ে ‘এক্সপ্লোরার’ হিসেবে টিনটিনের চরিত্রে মনোনিবেশ করেন, যাতে গেস্টাপোর হাতে গ্রেপ্তার এড়াতে পারেন। যুদ্ধের পর হার্জেকে সহযোগিতার অভিযোগে বেশ কয়েকবার গ্রেপ্তার করা হয়, যদিও তিনি কখনো অভিযুক্ত হননি। তিনি পরে বলেন, তাঁর বুর্জোয়া পটভূমি তাঁকে পক্ষপাতিত্ব থেকে মুক্ত হতে দেয়নি।

নতুন সংস্করণ ও প্রতিক্রিয়া

বিতর্কের জবাবে হার্জে পরবর্তী সংস্করণে কিছু পরিবর্তন আনেন। ‘টিনটিন ইন দ্য কঙ্গো’-তে আফ্রিকানদের ক্যারিকেচার কিছুটা কমানো হয় এবং ঔপনিবেশিক উল্লেখ মুছে ফেলা হয়। ২০২৩ সালে প্রকাশিত নতুন সংস্করণে একটি ভূমিকা যোগ করা হয়, যা ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করে।

এতে টিনটিন (Tintin) বেলজিয়ামকে ‘মাতৃভূমি’ বলার পরিবর্তে একটি শিশুকে অংক শেখায়। পরিবর্তন করা হয় কভারও। আগে টিনটিন একটি আফ্রিকান শিশুর পাশে বসে ছিল, এখন তিনি একটি সিংহের মুখোমুখি। ফ্রান্সের বর্ণবাদবিরোধী সংগঠন CRAN-এর প্রতিষ্ঠাতা প্যাট্রিক লোজেস এই ভূমিকাকে ‘সঠিক দিকে একটি পদক্ষেপ’ বলে স্বাগত জানান। তবে, কেউ কেউ মনে করেন, এটি হার্জের বর্ণবাদী অভিযোগ থেকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা।

ভারতের লর্ডস জয়! ক্রিকেটের পবিত্র মাটিতে তিন ঐতিহাসিক সাফল্য

শিক্ষার হাতিয়ার হিসেবে টিনটিন

বিতর্ক সত্ত্বেও, অনেকে মনে করেন টিনটিনকে (Tintin) নিষিদ্ধ করার পরিবর্তে শিক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা উচিত। ফ্রান্সের ইতিহাস ক্লাসে ‘টিনটিন ইন দ্য কঙ্গো’-এর মূল ও সংশোধিত সংস্করণ ব্যবহার করে ঔপনিবেশিকতা ও ডিকলোনাইজেশন পড়ানো হয়। শিশুদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বর্ণবাদী স্টিরিওটাইপ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো যায় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

টিনটিন (Tintin) কমিকস শুধুমাত্র একটি দুঃসাহসিক গল্প নয়, এটি ২০শ শতাব্দীর রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটের একটি দলিল। হার্জের প্রাথমিক কাজগুলো বর্ণবাদ, ঔপনিবেশিকতা এবং প্রোপাগান্ডার ছায়ায় মাখা থাকলেও, পরবর্তী অ্যালবামগুলোতে তিনি আরও পরিণত ও সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন।

‘টিনটিন ইন তিবেত’ বা ‘দ্য ব্লু লোটাস’-এর মতো গল্পে বন্ধুত্ব ও সাংস্কৃতিক সম্মানের বার্তা রয়েছে। তবু, বিতর্কিত অ্যালবামগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে অতীতের শিল্পকর্মকে সমালোচনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা প্রয়োজন। টিনটিনকে নিষিদ্ধ করার পরিবর্তে, এটিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে আমরা নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে উৎসাহিত করতে পারি।