পশ্চিমবঙ্গে আগামী বছরের শুরুতে আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের পটভূমিতে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (RSS) একটি বিরাট উদ্যোগ নিয়ে এসেছে, যা দেশব্যাপী ১,০৩,০১৯ জায়গায় হিন্দু সম্মেলনের ( Hindu Conferences) আয়োজনের পরিকল্পনা। এই উদ্যোগটি শুধুমাত্র একটি সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় আন্দোলন নয়, বরং এটি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিশেষ করে ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP) এবং শাসক তৃণমূল কংগ্রেস (TMC) এর মধ্যে হিন্দু ভোটের সমীকরণকে প্রভাবিত করতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। RSS-এর এই পদক্ষেপটি একটি সুদীর্ঘ ইতিহাস এবং গভীর রাজনৈতিক রাজ্যের সঙ্গে জড়িত, যা ১৯২৫ সালে স্থাপিত হওয়া থেকেই হিন্দু সম্প্রদায়কে একত্রিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও RSS-এর লক্ষ্য
RSS-এর সূচনা ঘটেছিল ব্রিটিশ শাসনামলের সময়, যখন হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে একত্বহীনতা এবং ভাগ্যবাদী মনোভাব লক্ষ্য করা যেত। সংঘের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলরাম হেডগেওয়ার এবং পরবর্তীতে ভিন্ন ভিন্ন নেতৃত্বে এই সংস্থাটি হিন্দুত্বের আদর্শকে প্রচারিত করতে শুরু করে। ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটি আজ ৬০,০০০-এর বেশি শাখা (Shakhas) এবং এখন ১ লক্ষের বেশি হিন্দু সম্মেলনের মাধ্যমে তার প্রভাব বাড়িয়ে তুলেছে। RSS-এর মূল লক্ষ্য হল হিন্দু সম্প্রদায়কে শক্তিশালী করা এবং একটি “হিন্দু রাষ্ট্র” স্থাপনের স্বপ্ন দেখা, যা ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার মূল্যবোধকে সমর্থন করে। এই নতুন উদ্যোগটি সেই স্বপ্নের একটি প্রসারিত রূপ হিসেবে দেখা যাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাব
পশ্চিমবঙ্গে RSS-এর এই হিন্দু সম্মেলন উদ্যোগটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে হিন্দু ভোটগুলো বিভক্ত রয়েছে BJP এবং TMC-এর মধ্যে। গত বিধানসভা নির্বাচনে TMC-এর পক্ষে হিন্দু ভোটের একটি বড় অংশ পাওয়া গিয়েছিল, যা আঞ্চলিকতার আদর্শের উপর ভিত্তি করে। তবে BJP এবং RSS একত্রিতভাবে এই ভোটগুলোকে একত্রিত করার চেষ্টা করছে, যা এই সম্মেলনের মাধ্যমে সম্ভব হতে পারে। সংঘের কর্মীরা এই সম্মেলনগুলো পরিচালনা করবে এবং সমস্ত রাজনৈতিক সংযোগের হিন্দুদের “বৈষম্যহীনভাবে” আমন্ত্রণ জানাবে, যা একটি “ঐক্য ও শান্তি” এবং “জাতির উন্নয়ন” এর বার্তা প্রচার করবে।
সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া
এই উদ্যোগটি সকলের কাছে সমর্থন পায়নি। কিছু বিশ্লেষক এটিকে রাজনৈতিক প্রভাব বাড়ানোর একটি কৌশল হিসেবে দেখছেন, যা ধর্মীয় ভাবনাকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলতে পারে। বিশেষ করে, সম্মেলনের সঙ্গে যুক্ত কিছু চিত্রে অস্ত্রধারীদের উপস্থিতি সমালোচনার কারণ হয়েছে, যা সাম্প্রদায়িক সংঘাতের ঝুঁকি বাড়াতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। তবে RSS এবং BJP-এর সমর্থকরা এই উদ্যোগটিকে হিন্দু পুনর্জাগরণের একটি আন্দোলন হিসেবে প্রচার করছেন, যা “বিজয়ী ভারত ২০৪৭” এর সামাজিক ভিত্তি তৈরি করবে।
বর্তমান পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ
বর্তমানে RSS-এর এই সম্মেলনের প্রস্তুতি চলছে, এবং এটি জুলাই মাসের শেষে বা আগস্ট মাসে শুরু হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় এই সম্মেলনগুলোর আয়োজনের জন্য স্থানীয় সংঘ কর্মীরা কাজ শুরু করে দিয়েছে। এই উদ্যোগটি কি সত্যিই হিন্দু ভোটকে একত্রিত করতে পারবে, নাকি এটি শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক প্রতীক হয়ে থাকবে, তা সময়ের সঙ্গে স্পষ্ট হবে। তবে একটি বিষয় নিশ্চিত যে, এই সম্মেলন বাংলার রাজনৈতিক মাঠে একটি নতুন দ্বন্দ্বের সূচনা করতে পারে।
RSS-এর এই বড় উদ্যোগটি শুধুমাত্র ধর্মীয় নয়, বরং রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাবের একটি গভীর পরিকল্পনা হিসেবে দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে, যেখানে আঞ্চলিকতা এবং ধর্মের মধ্যে সর্বদা একটি সংঘাত চলছে, এই সম্মেলনগুলো কীভাবে প্রভাব ফেলবে তা লক্ষণীয়। সংঘের এই পদক্ষেপটি হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে একত্ব এনে জাতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সংহতি বজায় রাখার চ্যালেঞ্জও বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই, এই সম্মেলনের ফলাফল এবং এর রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে বিশেষজ্ঞরা নজর রাখছেন, এবং সাধারণ মানুষও এই উদ্যোগটির প্রতি কৌতূহলী।