পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলা ভারতের আলু উৎপাদনের অন্যতম কেন্দ্র। এখানকার উর্বর মাটি এবং চাষিদের পরিশ্রম আলুকে রাজ্যের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ করে তুলেছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে, বিশেষ করে ২০২৫ সালে, হুগলির আলু চাষিরা (Hooghly potato farmer) রপ্তানি প্রত্যাখ্যান এবং বাজার মূল্যের পতনের কারণে গভীর সংকটের মুখোমুখি হয়েছেন। এই প্রতিবেদনে আমরা হুগলির একজন আলু চাষির জীবনের দৈনন্দিন সংগ্রাম, আর্থিক চাপ এবং তাঁদের অদম্য ইচ্ছাশক্তির গল্প তুলে ধরব।
আলু চাষের প্রেক্ষাপট
হুগলি, পশ্চিম মেদিনীপুর, বর্ধমান, বাঁকুড়া এবং মুর্শিদাবাদের মতো জেলাগুলি পশ্চিমবঙ্গের আলু উৎপাদনের প্রধান কেন্দ্র। ২০২২-২৩ সালে, রাজ্যে প্রায় ৪.৬ লক্ষ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছিল, যার মোট উৎপাদন ছিল প্রায় ১০০ লক্ষ টন। হুগলির চাষিরা জ্যোতি, পুখরাজ, চন্দ্রমুখী এবং সুপার-৬ জাতের আলু চাষ করে থাকেন, যার মধ্যে জ্যোতি জাতটি সবচেয়ে জনপ্রিয়। কিন্তু এই বছরের বাম্পার ফলন এবং রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে চাষিরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন।
রপ্তানি প্রত্যাখ্যানের প্রভাব
২০২৫ সালে, হুগলির আলু রপ্তানির ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রত্যাখ্যানের সম্মুখীন হয়। রাশিয়া এবং অন্যান্য দেশে রপ্তানির প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, প্রতিবেশী রাজ্য যেমন উত্তরপ্রদেশের বাম্পার উৎপাদন এবং স্থানীয় বাজারে প্রতিযোগিতার কারণে হুগলির আলু বাজার হারিয়েছে। রাজ্য সরকারের পূর্ববর্তী রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা, যা ২০২৪ সালে উঠে গেলেও, বাজারের ক্ষতি পূরণ করতে পারেনি। ফলে, ৬৬ লক্ষ টন আলু ঠান্ডা গুদামে পড়ে থেকেছে, যেখানে রাজ্যের চাহিদা মাত্র ৩০-৩২ লক্ষ টন।
এই পরিস্থিতি চাষিদের জন্য বিপর্যয়কর। উদাহরণস্বরূপ, হুগলির আরামবাগের রায়পুর গ্রামের চাষি তপন জানা ২০২৫ সালে চার বিঘা জমিতে আলু চাষ করে লাভের আশা করেছিলেন। কিন্তু বাজার মূল্য প্রতি কেজিতে ৩ টাকায় নেমে যাওয়ায় তিনি বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হন। উৎপাদন খরচ ছিল প্রতি কেজি ৫.৫০-৬ টাকা, যা তাঁর পক্ষে পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। হতাশায় তিনি কীটনাশক খেয়ে আত্মহত্যা করেন। তাঁর স্ত্রী পূর্ণিমা বলেন, “আমি তাঁকে অন্য ফসল চাষের পরামর্শ দিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি শোনেননি। আমার সোনার গয়না বন্ধক দিয়ে তিনি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়েছিলেন।” এই ঘটনা হুগলির আলু চাষিদের মর্মান্তিক অবস্থার প্রতিফলন।
দৈনন্দিন জীবনের সংগ্রাম
হুগলির আলু চাষিদের জীবন কঠিন শ্রম আর অনিশ্চয়তায় ভরা। এক বিঘা জমিতে আলু চাষে কমপক্ষে ২৫,০০০-৩০,০০০ টাকা খরচ হয়, যার মধ্যে রয়েছে বীজ, সার, কীটনাশক, শ্রমিক এবং জল সরবরাহের খরচ। প্রতি বিঘা থেকে ৭০-৮০ বস্তা আলু (প্রায় ৩৫-৪০ কুইন্টাল) উৎপাদন হলেও, বাজার মূল্য ৫৪০-৯০০ টাকা প্রতি কুইন্টালে নেমে গেছে। এই দামে চাষিরা উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না।
মালিয়া গ্রামের চাষি জয়ন্ত সোরেন বলেন, “আমরা গত বছর ভালো লাভ করেছিলাম, তাই এই বছর আরও বেশি আলু চাষ করেছি। কিন্তু বীজের দাম ৫,০০০ টাকা প্রতি বস্তায় উঠে গেছে, আর বাজারে দাম মাত্র ৩০০-৪০০ টাকা প্রতি কুইন্টাল। আমরা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছি।” তিনি আরও বলেন, “অনেক সময় ঠান্ডা গুদামে আলু রাখার খরচও তুলতে পারি না।” ঠান্ডা গুদামে আলু রাখার খরচ প্রতি কেজি ৪-৫ টাকা, যা চাষিদের জন্য অতিরিক্ত বোঝা।
সরকারি নীতির সীমাবদ্ধতা
রাজ্য সরকার দাবি করেছে যে তারা চাষিদের সাহায্য করছে। কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায় জানিয়েছেন, “আমরা ৫০,০০০ টন আলু কেনার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ করেছি। আমরা রাশিয়ায় আলু রপ্তানি শুরু করেছি এবং অন্যান্য রপ্তানি চুক্তি চূড়ান্ত করছি।” তবে, হুগলি পটেটো ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি লালু মুখার্জি বলেন, “সরকার খুব কম পরিমাণ আলু কিনেছে। কলকাতা হাইকোর্ট সম্প্রতি বলেছে যে সরকারের ক্রয় নীতি চাষিদের উপকার করছে না।”
এছাড়া, অনেক চাষি ভাগচাষি হওয়ায় জমির মালিকানা নথি না থাকার কারণে সরকারি ক্রয় প্রকল্পে অংশ নিতে পারেন না। উৎপাদন খরচের তুলনায় সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (এমএসপি) ৬০০ টাকা প্রতি কুইন্টাল, যা চাষিদের মতে অপ্রতুল। উৎপল রায়, হুগলির খানাকুলের একজন চাষি, বলেন, “যদি সরকার প্রতি কুইন্টাল ১,৩০০ টাকায় কিনত, তাহলে আমরা অন্তত খরচ তুলতে পারতাম।”
জীবনের স্থিতিস্থাপকতা
এই সংকট সত্ত্বেও, হুগলির চাষিরা হাল ছাড়েননি। অনেকে বিকল্প ফসল যেমন ধান বা সরিষার দিকে ঝুঁকছেন। কেউ কেউ পেপসিকোর মতো সংস্থার সাথে চুক্তিভিত্তিক চাষে যোগ দিচ্ছেন, যা নিশ্চিত আয় প্রদান করে। বাঁকুড়ার শিরোমণিপুর গ্রামের মেঘনজন দত্ত বলেন, “চুক্তিভিত্তিক চাষে আমরা বাজারের ঝুঁকি এড়াতে পারি। পেপসিকো আমাদের বীজ, ঋণ এবং ফসলের নিশ্চিত ক্রয়ের ব্যবস্থা করে।”
এছাড়া, কিছু চাষি নিজেদের উৎপাদন প্রক্রিয়া উন্নত করার চেষ্টা করছেন। হুগলির বালাইচক গ্রামের নির্মল মণ্ডল বলেন, “আমরা আধুনিক চাষ পদ্ধতি এবং ভালো মানের বীজ ব্যবহার করছি। কিন্তু সরকারি সাহায্য ছাড়া আমাদের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন।”
হুগলির আলু চাষিরা রপ্তানি প্রত্যাখ্যান এবং কম বাজার মূল্যের কারণে গভীর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের দৈনন্দিন জীবন ঋণ, ক্ষতি এবং অনিশ্চয়তায় ভরা। তবুও, তাঁদের স্থিতিস্থাপকতা এবং নতুন কৌশল গ্রহণের প্রচেষ্টা আশার আলো দেখায়। সরকারের কার্যকর নীতি, রপ্তানি সুবিধা এবং ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা গেলে হুগলির চাষিরা তাঁদের হারানো সমৃদ্ধি ফিরে পেতে পারেন। এই গল্প শুধু হুগলির নয়, ভারতের কৃষি সম্প্রদায়ের সংগ্রাম ও আশার প্রতিফলন।