ভারতের ডিজিটাল পেমেন্ট সিস্টেম যুক্ত পেমেন্ট ইন্টারফেস (UPI) বিশ্বের বিভিন্ন কোণে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়ে চলেছে। সাম্প্রতিক সময়ে ইউপিআইয়ের বিস্তার একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হয়ে উঠেছে, যা ভারতের টেক সাম্রাজ্যের একটি শক্তিশালী প্রমাণ। গতকাল, ৬ জুলাই, ট্রিনিডাড ও টোবাগোর মতো ক্যারিবিয়ান দেশটি ইউপিআই গ্রহণের মাধ্যমে এই সিস্টেমের বিস্তৃতি আরও প্রসারিত করেছে। এর ফলে এখন পর্যন্ত মোট ৮টি দেশে ইউপিআই লেনদেন চালু হয়েছে, যা ভারতীয় প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক প্রভাবের একটি গল্প বলে।
ইউপিআই কী?
ইউপিআই হলো ভারতের ন্যাশনাল পেমেন্টস কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া (এনপিসিআই) কর্তৃক উন্নত একটি ডিজিটাল পেমেন্ট পদ্ধতি, যা ২০১৬ সালে প্রথম চালু হয়। এই সিস্টেমের মাধ্যমে ব্যবহারকারী ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টকে একটি মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সংযোগ করে কিউআর কোড স্ক্যান বা ফোন নম্বরের মাধ্যমে দ্রুত লেনদেন সম্পন্ন করতে পারেন। এর সহজ ব্যবহার এবং কম খরচের কারণে এটি ভারতের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, এবং এখন এটি সীমানা পার হয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রসারিত হচ্ছে।
কোন কোন দেশে ইউপিআই চালু?
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ইউপিআই এখন পর্যন্ত নিম্নলিখিত ৮টি দেশে চালু হয়েছে:
1. *ফ্রান্স* – ২০২৪ সালে ফ্রান্স প্রথম ইউরোপীয় দেশ হিসেবে ইউপিআই গ্রহণ করে, যা এনপিসিআই ও লিরা-এর সহযোগিতায় সম্ভব হয়।
2. *ইউএই* – ২০২১ সালে কিউআর কোডের মাধ্যমে ইউএই-এ ইউপিআই চালু হয়, যা ভারতীয় পর্যটকদের জন্য বিশেষ সুবিধাজনক।
3. *ভুটান* – ২০২১ সালে ভুটান প্রথম দেশ হিসেবে ভারতের বাইরে ইউপিআই গ্রহণ করে।
4. *নেপাল* – ভারতের সংলগ্ন দেশ হিসেবে নেপালে এই সিস্টেম সীমানা পার লেনদেনকে সহজ করেছে।
5. *মরিশাস* – মরিশাসে ইউপিআই-এর প্রবেশ ভারতীয় ব্যবসায়ীদের জন্য একটি নতুন দ্বার খুলে দিয়েছে।
6. *শ্রীলঙ্কা* – এই দক্ষিণ এশিয়ার দেশটিও ইউপিআই-এর সুবিধা গ্রহণ করেছে।
7. *সিঙ্গাপুর* – এশিয়ার এই উন্নত অর্থনীতি ইউপিআই-এর সাথে একত্রিত হয়ে আন্তর্জাতিক লেনদেনকে ত্বরান্বিত করেছে।
8. *ট্রিনিডাড ও টোবাগো* – সম্প্রতি এই ক্যারিবিয়ান দেশটি প্রথমবারের মতো ইউপিআই গ্রহণ করে, যা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অভিনন্দন পেয়েছে।
ইউপিআই-এর বিস্তারের কারণ
ইউপিআই-এর বিশ্বব্যাপী বিস্তারের পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। প্রথমত, এটির কম লেনদেন খরচ, যা ২০২৪ সালের একটি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া অধ্যয়ন অনুযায়ী, ঐতিহ্যবাহী পেমেন্ট পদ্ধতির তুলনায় ২৫% খরচ কমিয়েছে। দ্বিতীয়ত, এটি ব্যবহারকারী বান্ধব এবং দ্রুত, যা বিশেষ করে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয়। তৃতীয়ত, ভারত সরকার এবং এনপিসিআই-এর আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, যেমন জাপান ও ফ্রান্সের সাথে স্বাক্ষরিত মেমোরান্ডাম অফ আন্ডারস্ট্যান্ডিং (এমওইউ), এই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করেছে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ইউপিআই-এর বিস্তার এখানেই থামবে না। ২০২৫ সালে আরও ৪-৬টি দেশে এই সিস্টেম প্রবর্তনের পরিকল্পনা রয়েছে, যার মধ্যে কাতার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইউকে, ওমান এবং মালদ্বীপের নাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়া, ২০২৬ সালে প্রকল্প নেক্সাসের মাধ্যমে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলোর মধ্যে একটি বহুপক্ষীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক খুচরা পেমেন্ট সিস্টেমকে সংযোগ করবে।
ভারতের জন্য গর্বের বিষয়
ইউপিআই-এর বিশ্বব্যাপী সাফল্য ভারতের জন্য একটি গর্বের বিষয়। এটি শুধুমাত্র একটি পেমেন্ট সিস্টেম নয়, বরং নতুন ভারতের প্রযুক্তিগত নেতৃত্বের একটি প্রতীক। ৩৮০ মিলিয়ন ব্যবহারকারী এবং দ্রুত বাড়তে থাকা লেনদেনের পরিমাণ বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। পূর্বে কিছু সমালোচক, যেমন পূর্ববর্তী অর্থমন্ত্রী পি. চিদম্বরম, ইউপিআই-কে অতিরঞ্জিত বলে মনে করেছিলেন, কিন্তু আজ এটি একটি বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছে।
চ্যালেঞ্জ ও সতর্কতা
তবে, এই বিস্তারের সাথে সাথে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। ডিজিটাল লেনদেনের বৃদ্ধির সাথে সাইবার স্ক্যাম ও প্রতারণার ঘটনা বাড়ছে। এনপিসিআই এবং সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলো এই সমস্যার সমাধানে কাজ করছে। ব্যবহারকারীদেরও সচেতন থাকতে হবে এবং নিরাপদ লেনদেনের নিয়ম মেনে চলতে হবে।
ইউপিআই-এর বিস্তার ভারতের ডিজিটাল অর্থনীতির একটি নতুন যুগের সূচনা। ট্রিনিডাড ও টোবাগোর মতো দূরবর্তী দেশে এর প্রবেশ ভারতীয় প্রযুক্তির বিশ্বব্যাপী প্রভাবের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ। ভবিষ্যতে আরও দেশে এই সিস্টেমের প্রসার ঘটলে, ভারত শুধুমাত্র একটি টেক নেতা হিসেবে নয়, একটি গ্লোবাল ফিনটেক শক্তি হিসেবেও চিহ্নিত হবে। তাই, ভারতীয় নাগরিকদের জন্য এটি গর্বের মধ্যে একটি গল্প, যা প্রযুক্তি ও সংযোগের মাধ্যমে বিশ্বের সাথে হাত মেলাতে সাহায্য করছে।