মার্কেট ম্যানিপুলেশন বা বাজারে কারসাজি কোনোভাবেই সহ্য করা হবে না বলে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (SEBI)-এর চেয়ারপারসন তুহিন কান্ত পাণ্ডে। শনিবার বোম্বেতে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস সোসাইটি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, “মার্কেট ম্যানিপুলেশন সহ্য করা হবে না। এটি রোধ করতে নজরদারি আরও জোরদার করা হয়েছে।”
এই বক্তব্যের একদিন আগেই, সেবি মার্কিন ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান Jane Street এবং এর তিনটি সহযোগী সংস্থাকে ভারতের শেয়ার বাজারে অংশগ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। একই সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানগুলিকে মোট ৪,৮৪৩.৫ কোটি টাকার অবৈধ আয় সেবির অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সেবির নির্দেশে জানানো হয়েছে, Jane Street গ্রুপের এই প্রতিষ্ঠানগুলি হলো JSI2 Investments Private Ltd, Jane Street Singapore Pte. Ltd এবং Jane Street Asia Trading Ltd। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত সময়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলি ভারতের এক্সচেঞ্জে ইনডেক্স অপশন ট্রেডিং থেকে ৪৩,২৮৯.৩৩ কোটি টাকার মুনাফা করেছে বলে অভিযোগ।
সেবির চেয়ারম্যান তুহিন কান্ত পাণ্ডে বলেন, “চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টদের (CAs) জন্য গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো কর্পোরেট গভর্ন্যান্সকে কোনো চেকলিস্টে সীমাবদ্ধ না করা। সংশ্লিষ্ট পার্টি লেনদেনের (related party transactions) স্বচ্ছতা, স্বার্থের সংঘাতের সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং তাৎক্ষণিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশ করা — এগুলো কোনোভাবেই অগ্রাহ্য করা যাবে না। এগুলো একেবারে ‘নন-নেগোশিয়েবল’।”
তিনি আরও বলেন, “অতিরিক্ত কমপ্লায়েন্সের কারণে অনেক সময় বড় ধরনের প্রশাসনিক বোঝা তৈরি হয়। আমরা চাই কম নিয়ম মেনে হলেও ভালো ফলাফল নিশ্চিত করা যায়, সেই দিকটিও দেখতে হবে।”
Jane Street গ্রুপের বিরুদ্ধে সেবির অভিযোগ, তারা ইন্ডিয়ান এক্সচেঞ্জে অপশন ট্রেডিং করে অনৈতিকভাবে বিশাল অঙ্কের মুনাফা করেছে এবং তা সঠিকভাবে প্রকাশ করেনি। সেবি এই ধরনের অনিয়ম এবং অবৈধ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে Jane Street-এর সব ভারতীয় ব্যাংক অ্যাকাউন্টেও ডেবিট ফ্রিজের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এই পদক্ষেপের মাধ্যমে, Jane Street গ্রুপ এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলিকে ভারতের পুঁজিবাজারে কোনো ধরনের লেনদেন বা ব্যবসায়িক কার্যকলাপ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকতে হবে।
উল্লেখযোগ্য যে, Jane Street সেবির অন্তর্বর্তী নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করেছে এবং তারা বলেছে, “আমরা সেবির এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত নই এবং নিয়ন্ত্রকের সঙ্গে আরও আলোচনায় যাব।”
এদিকে সেবির এই কঠোর অবস্থান বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা ফেরাতে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বাজার বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এ ধরনের দৃঢ় পদক্ষেপের ফলে বাজারের স্বচ্ছতা এবং ন্যায়পরায়ণতা নিশ্চিত করা সম্ভব।
সেবির মতে, ভারতের পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা এবং আস্থা রক্ষার জন্য বাজারের সব অংশগ্রহণকারীকে সঠিক নিয়ম মেনে চলতে হবে। কোনো ধরনের অনৈতিক কাজ বা বাজার কারসাজি ধরা পড়লে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, গত কয়েক বছরে সেবি বিভিন্ন ট্রেডিং কোম্পানি এবং ব্রোকারদের বিরুদ্ধে এ ধরনের কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে ফ্রন্ট-রানিং, ইনসাইডার ট্রেডিং, প্রাইস ম্যানিপুলেশনসহ বিভিন্ন অভিযোগে বহু কোম্পানিকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।
তুহিন কান্ত পাণ্ডে বলেন, “সবার জন্য সমান নিয়ম প্রযোজ্য। এ ধরনের অনিয়মের ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ক্ষতি হয় এবং বাজারের উপর মানুষের বিশ্বাস নষ্ট হয়। এজন্যই সেবি বারবার বলে আসছে — নিয়ম ভঙ্গ করলে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।”
তিনি আরও উল্লেখ করেন যে সেবি ভবিষ্যতে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করে নজরদারি আরও জোরদার করবে, যাতে ট্রেডিং প্যাটার্ন থেকে সহজেই সন্দেহজনক কার্যকলাপ চিহ্নিত করা যায়।
অর্থনীতি বিশ্লেষকদের মতে, সেবির এই পদক্ষেপ একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। এর মাধ্যমে দেশি-বিদেশি সব প্রতিষ্ঠানের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে ভারতের পুঁজিবাজারে কোনো ধরনের কারসাজি বা অনিয়মের সুযোগ নেই।
এখন দেখার বিষয়, Jane Street তাদের পক্ষে কী ধরনের যুক্তি পেশ করে এবং সেবির সঙ্গে আলোচনায় কোন পথে এগোয়। তবে আপাতত তাদের ভারতে ব্যবসায়িক কার্যকলাপ স্থগিত এবং বিপুল অঙ্কের অর্থ জমা দেওয়ার নির্দেশের ফলে আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ও কিছুটা ধাক্কা খেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাজারের বিনিয়োগকারীরা আশা করছেন, সেবির এই পদক্ষেপ দীর্ঘমেয়াদে বাজারকে আরও সুদৃঢ় এবং ন্যায্য করবে।