২০২৫ সালের জুন মাসে ভারতের বাজারে ইলেকট্রিক টু-হুইলার বা ই-বাইকের (Electric Two-Wheeler) বিক্রি ৯৩,৮৭২ ইউনিটে পৌঁছেছে, যা বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উত্তেজনা এবং আশার একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এই অঙ্কটি শুধুমাত্র একটি সংখ্যা নয়; এটি একটি সবুজ বিপ্লবের প্রতীক, যেখানে পরিবেশগত সচেতনতা, জ্বালানি মূল্যের ঊর্ধ্বমুখী চাপ এবং সরকারি উৎসাহ প্রদানের ফলে ই-ভেহিকলের দিকে একটি দ্রুত প্রবৃত্তি দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, এই বিক্রয় বৃদ্ধি গত বছরের তুলনায় ২১% বেশি, যা ই-টু-হুইলার খাতটির মোট ইলেকট্রিক গাড়ির বিক্রয়ের ৫৮.৪৯% ভাগ দখল করার ক্ষমতা প্রদর্শন করে। এই প্রবণতা কি ভারতকে একটি পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যৎের দিকে নিয়ে যাবে? আসুন এই বিষয়ে গভীরে ঢুকে দেখি।
ই-বাইকের উত্থান: কারণ ও প্রভাব
ই-বাইকের বিক্রয়ে এই হঠাৎ বৃদ্ধির পেছনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ রয়েছে। প্রথমত, পেট্রোলের দামের অস্থিরতা এবং শহরগুলোতে যানবাহন জটের সমস্যা গাড়ির মালিকদের ই-বাইকের দিকে ঝুঁকিয়ে দিয়েছে। দ্বিতীয়ত, সরকারের ফাস্টার অ্যাডপশন অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং অফ হাইব্রিড অ্যান্ড ইলেকট্রিক ভেহিকলস (FAME) স্কিমের মাধ্যমে প্রদত্ত সাবসিডি এবং ট্যাক্স ছাড় ব্যক্তিগত এবং ব্যবসায়িক ক্রেতাদের জন্য এই গাড়ি কেনার খরচ কমিয়ে দিয়েছে। তৃতীয়ত, পরিবেশ দূষণ কমানোর প্রয়োজনীয়তা এবং শক্তি নির্ভরতা হ্রাস করার লক্ষ্যে সরকারী নীতিগুলো ই-ভেহিকল উৎপাদন ও ব্যবহারকে উৎসাহিত করছে।
এই বিক্রয়ের প্রভাবও উল্লেখযোগ্য। ৯৩,৮৭২ ই-বাইকের বিক্রি শুধুমাত্র শহরের বাতাসের মান উন্নত করতে সাহায্য করবে না, বরং পারিবারিক ব্যয়ে বাঁচতেও সহায়ক হবে। ই-বাইকের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ এবং চলার খরচ সাধারণ পেট্রোল বাইকের তুলনায় অনেক কম, যা মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য একটি আকর্ষণীয় বিকল্প হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, একটি গবেষণা অনুসারে, ই-স্কুটারের প্রতি কিলোমিটার চলার খরচ প্রায় ১০ থেকে ১৫ পয়সা, যেখানে পেট্রোল বাইকের তা ৫ থেকে ৭ টাকা।
অঞ্চলভিত্তিক প্রবণতা: দক্ষিণ ভারতের নেতৃত্ব
দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলো, বিশেষ করে তামিলনাড়ু, কর্ণাটক এবং কেরালা, ই-বাইকের ব্যবহারে এগিয়ে আছে। স্থানীয় পর্যবেক্ষকদের মতে, এই অঞ্চলে শিক্ষিত সমাজ এবং পরিবেশ সংরক্ষণের প্রতি সচেতনতা বেশি থাকায় এই প্রবৃত্তি দেখা দিয়েছে। তাছাড়া, এই অঞ্চলে শিল্পক্ষেত্রে ই-ভেহিকল উৎপাদনের উন্নতি এবং চার্জিং স্টেশনের বিস্তারও এর জন্য দায়ী। তবে, পূর্ব ও উত্তর ভারতের তুলনায় এখনো চার্জিং ইনফ্রাস্ট্রাকচারের অভাব একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
ই-বাইকের বিক্রয় বৃদ্ধি সত্ত্বেও, চার্জিং স্টেশনের সংখ্যা এবং বিদ্যুৎ বিতরণ ক্ষমতা এখনো পিছিয়ে রয়েছে। বিশ্ব ব্যাঙ্কের একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ভারতের বর্তমান বিদ্যুৎ গ্রিড ২০৩০ সালের ৮০% ই-টু-হুইলার লক্ষ্য অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত নাও হতে পারে। তবে, সরকার ইতিমধ্যে প্রায় ১২৫.৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে চার্জিং নেটওয়ার্ক বিকাশে কাজ করছে। প্রধান কোম্পানি যেমন ডেল্টা ইলেকট্রনিক্স, এবিবি ইন্ডিয়া এবং এক্সিকম এই খাতে তাদের ভূমিকা পালন করছে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে, প্রাথমিক বিনিয়োগ খরচ এখনো বেশিরভাগ গ্রাহকের জন্য একটি বাধা। তবে, প্রতিযোগিতার ফলে বাজারে সস্তা মডেল আসছে, যা এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে। উদাহরণস্বরূপ, ওলা ইলেকট্রিক এবং হিরো মোটোকর্পের মতো কোম্পানি অ্যাফোর্ডেবল মডেল চালু করে বাজারে প্রভাব বাড়াচ্ছে।
ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি
ভারতীয় বাজারে ই-বাইকের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল মনে হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ২০৩০ সালের মধ্যে টু-হুইলারের ৩৫-৪০% বিক্রয় ই-ভার্সন থেকে আসবে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকারি নীতি, ব্যবসায়িক উদ্যোগ এবং গ্রাহক সচেতনতার সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। তাছাড়া, বৈদ্যুতিন গাড়ির জন্য উন্নত ব্যাটারি প্রযুক্তি এবং পুনর্জননযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়লে এই খাতটি আরও সমৃদ্ধ হবে।
সামগ্রিকভাবে, ৯৩,৮৭২ ই-বাইকের বিক্রয় জুন ২০২৫-এ একটি নতুন অধ্যায়ের শুরু। এটি শুধুমাত্র পরিবহন খাতে একটি পরিবর্তন নয়, বরং ভারতের পরিবেশ ও অর্থনীতিতে একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি। তবে, এই পথে চলতে গিয়ে চার্জিং ইনফ্রাস্ট্রাকচার এবং বিদ্যুৎ সরবরাহের বিস্তারে ত্বরান্বিত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। যদি এই চ্যালেঞ্জগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করা যায়, তবে ভারত বিশ্বের ই-ভেহিকলের নেতৃত্বে এগিয়ে যেতে পারে, যা একটি স্বপ্নের বেশি কিছু নয়।