জল বন্ধের হুমকি দিয়েও পাকিস্তানে রফতানি বৃদ্ধি ভারতের

India Exports to Pakistan : পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দিয়ে একাধিকবার জল বন্ধের হুমকি দিয়েছে ভারত। আন্তর্জাতিক স্তরেও বিষয়টি বারবার আলোচনায় এসেছে। ২০১৬ সালের উরির…

India Boosts Exports to Pakistan to $211.5M in FY25 Despite Water Threats and Tensions

India Exports to Pakistan : পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দিয়ে একাধিকবার জল বন্ধের হুমকি দিয়েছে ভারত। আন্তর্জাতিক স্তরেও বিষয়টি বারবার আলোচনায় এসেছে। ২০১৬ সালের উরির হামলার পর থেকে বারবারই ভারতের শীর্ষ নেতৃত্ব ইন্দুস জলের প্রবাহ থামানোর বার্তা দিয়েছে ইসলামাবাদকে। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক স্তরে দুই দেশের সম্পর্ক ক্রমশ তলানিতে ঠেকেছে।

তবে অবাক করা বিষয়, এই রাজনৈতিক উত্তেজনা, সীমান্ত সংঘর্ষ এমনকি জল-রাজনীতির আবহেও ভারতের থেকে পাকিস্তানে রফতানি এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অফ পাকিস্তান (SBP) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের জুলাই-মে সময়কালে ভারতের থেকে আমদানি পৌঁছেছে ২১১.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে, যা গত তিন বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।

   

দ্বিপাক্ষিক সংঘর্ষের মধ্যেও রেকর্ড আমদানি
২০২৫ সালের মে মাসেই—যখন মাসের শুরুতে মাত্র চার দিনের এক সীমান্ত সংঘর্ষ হয়—সেই সময়ও পাকিস্তান ভারত থেকে ১৫ মিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। যদিও আগের বছরের মে মাসে সেই অঙ্ক ছিল ১৭ মিলিয়ন ডলার, তবুও এই সংঘর্ষের আবহে এমন আমদানি বিস্ময়কর বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে এই আমদানির অঙ্ক ছিল ২০৭ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২২-২৩ সালে ১৯০ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, তিন বছরে স্থিরভাবেই বেড়েছে পাকিস্তানে ভারতের রফতানি।

পাকিস্তান থেকে ভারতে রফতানি কার্যত শূন্য
এই বাণিজ্য যদিও শুধুই একমুখী। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ভারতে রফতানির পরিমাণ ন্যূনতম। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে (জুলাই-মে) পাকিস্তান ভারতে রপ্তানি করেছে মাত্র ৫ লক্ষ ডলারের পণ্য। মে মাসে সেই রফতানি ছিল মাত্র ১ হাজার ডলার! পূর্ববর্তী বছরগুলিতেও চিত্র একই রকম। ২০২৩-২৪ সালে রপ্তানি ছিল ৩.৪৪ মিলিয়ন ডলার এবং ২০২২-২৩ সালে মাত্র ৩.৩ লক্ষ ডলার।

ব্যবসায়ীরা মুখ খুলছেন না, সন্দেহ তৃতীয় দেশের মাধ্যমে আমদানির
এই রফতানির বিপুল বৃদ্ধির সময়কাল রাজনৈতিক উত্তেজনার সাথে মিলে যাওয়ায় অনেক ব্যবসায়ী মুখ খুলতে নারাজ। করাচির এক আমদানিকারক বলেন, “এই পণ্যগুলি হয়তো সরাসরি ভারত থেকে আসেনি। তৃতীয় কোনো দেশের (যেমন দুবাই, কলম্বো, সিঙ্গাপুর) মাধ্যমে এসেছে। যুদ্ধের আগে টাকাও পরিশোধ করা হয়ে থাকতে পারে।”

জল-কূটনীতির ছায়ায় চোরাপথে অর্থনৈতিক সংযোগ
ভারতের পক্ষ থেকে বারবার পাকিস্তানকে ইন্দুস জলচুক্তি বাতিলের হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। ১৯৬০ সালে স্বাক্ষরিত এই চুক্তি অনুযায়ী ভারতের তিনটি নদীর জল পাকিস্তানে প্রবাহিত হয়। তবে সাম্প্রতিক সংঘর্ষের পর সেই জল সরবরাহ নিয়ে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে পাকিস্তানে।

তবে জল বন্ধের হুমকি, সামরিক উত্তেজনা, বা সীমান্তে কড়া বার্তার মাঝেও রফতানির এই ধারাবাহিক বৃদ্ধি প্রশ্ন তোলে—বাস্তবে কি অর্থনীতিই এখন কূটনীতিকে ছাপিয়ে যাচ্ছে?

Advertisements

বাস্তব চিত্র: অপ্রাতিষ্ঠানিক বাণিজ্যে ভারতের আধিপত্য
ভারতের গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (GTRI) সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, পাকিস্তানে ভারতের অপ্রাতিষ্ঠানিক রফতানি প্রতি বছর প্রায় ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার! এই পণ্যগুলি মূলত দুবাই, সিঙ্গাপুর ও কলম্বোর মতো তৃতীয় দেশ ঘুরে পাকিস্তানে পৌঁছে যায়।

এই চোরাপথের ব্যবসা পাকিস্তানের উত্পাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বেশ জনপ্রিয়। পাকিস্তানি বিশ্লেষকদের মতে, “আমাদের দেশের উৎপাদন ব্যয় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ। এতে ভারত, চীন ও বাংলাদেশের তুলনায় আমাদের শিল্পখাত পিছিয়ে পড়ছে। ফলে সীমান্ত দিয়ে বা তৃতীয় দেশের মাধ্যমে সস্তা পণ্য আসার রাস্তা খুলে যায়।”

রাজনৈতিক হুমকির সঙ্গে অর্থনৈতিক নির্ভরতা: এক অদ্ভুত সাদৃশ্য
২০১৯ সাল থেকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে আনুষ্ঠানিক বাণিজ্য সম্পর্ক কার্যত বন্ধ। কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলুপ্তির পর পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থগিত করে। তবুও তিন বছর পরে দেখা যাচ্ছে, ভারতের ওপর আমদানির নির্ভরতা আরও বেড়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এটি এক অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব—একদিকে পাকিস্তান রাজনৈতিকভাবে ভারতকে ‘প্রতিপক্ষ’ বলছে, অন্যদিকে ভারতীয় শিল্পপণ্য ছাড়া দেশীয় শিল্প স্থবির হয়ে পড়ছে।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক যতই সংকটপূর্ণ হোক, অর্থনৈতিক বাস্তবতা তার উল্টো ছবি দেখাচ্ছে। জল বন্ধের হুমকি, সামরিক সংঘর্ষ, কূটনৈতিক তিক্ততা—সব কিছুর মধ্যেও রফতানি বাড়িয়ে চলেছে ভারত। পাকিস্তানও সেই পণ্য নিতে বাধ্য হচ্ছে, কারণ অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণের ক্ষমতা তাদের নেই।

তাই এই প্রশ্ন এখন স্বাভাবিক—জল নয়, সত্যিকারের চাপ কি ভারতের পণ্যই? আর অর্থনীতিই কি এখন উপমহাদেশের নতুন কূটনীতি? সময়ই তার উত্তর দেবে।