ভারতে জৈব কৃষকদের জন্য নতুন ‘স্বর্ণখনি’ গিলয় চাষ

Giloy Cultivation in India: ভারতের কৃষি খাতে গিলয় (টিনোস্পোরা কর্ডিফোলিয়া), যিনি আয়ুর্বেদে ‘অমৃতা’ বা ‘গুডুচী’ নামে পরিচিত, একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে। এই ঔষধি…

Giloy Cultivation in India

Giloy Cultivation in India: ভারতের কৃষি খাতে গিলয় (টিনোস্পোরা কর্ডিফোলিয়া), যিনি আয়ুর্বেদে ‘অমৃতা’ বা ‘গুডুচী’ নামে পরিচিত, একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করছে। এই ঔষধি উদ্ভিদটি তার অসংখ্য স্বাস্থ্য উপকারিতার জন্য সুপরিচিত এবং সাম্প্রতিক বছরগুলিতে এর চাহিদা দেশে এবং বিদেশে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জৈব কৃষকদের জন্য গিলয় চাষ এখন একটি লাভজনক ব্যবসায়িক সুযোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যা কম বিনিয়োগে উচ্চ মুনাফা প্রদান করছে। এই প্রতিবেদনে আমরা গিলয় চাষের সম্ভাবনা, এর অর্থনৈতিক উপকারিতা এবং জৈব কৃষকদের জন্য এর গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করব।

গিলয়ের ঔষধি গুণাবলী এবং বাজার চাহিদা
গিলয় ভারতীয় আয়ুর্বেদে একটি শক্তিশালী রসায়ন ঔষধ হিসেবে পরিচিত। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, জ্বর, ডায়াবেটিস, জন্ডিস, ত্বকের সমস্যা এবং এমনকি কোভিড-১৯ এর মতো ভাইরাল সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কার্যকর। গিলয়ের কাণ্ড, পাতা এবং মূল বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এর অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং ইমিউনোমডিউলেটরি বৈশিষ্ট্যের কারণে এটি ফার্মাসিউটিক্যাল এবং জৈব পণ্য শিল্পে অত্যন্ত মূল্যবান।

   

সাম্প্রতিক তথ্য অনুসারে, গিলয়ের বার্ষিক চাহিদা ভারতে প্রায় ১০০০ টন, এবং এর জলীয় নির্যাসের বিশ্বব্যাপী চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুতকারক, স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং রপ্তানিকারকরা গিলয়ের জন্য বাজারে প্রতিযোগিতা করছে। এই ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে জৈব কৃষকদের জন্য গিলয় চাষ একটি লাভজনক বিকল্প হয়ে উঠেছে।

গিলয় চাষের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা
গিলয় চাষ কম বিনিয়োগে উচ্চ লাভের সম্ভাবনা রাখে। এক হেক্টর জমিতে গিলয় চাষ করে দ্বিতীয় বছর থেকে প্রায় ৬০,০০০ টাকার আয় করা সম্ভব। এছাড়াও, সমর্থন গাছ (যেমন নিম) এবং স্বল্পমেয়াদী ফসলের সাথে মিশ্র চাষের মাধ্যমে প্রথম বছর থেকেই বছরে গড়ে ১ লক্ষ টাকার আয় সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, মধ্যপ্রদেশের একজন কৃষক, কালু সিং, জানিয়েছেন যে তিনি ০.৫ একর জমিতে অশ্বগন্ধা চাষ করে ২.২ একর গম চাষের সমান মুনাফা অর্জন করেছেন। গিলয়ের ক্ষেত্রেও অনুরূপ সম্ভাবনা রয়েছে।

Giloy Cultivation in India
Giloy Cultivation in India

গিলয় চাষে বিনিয়োগ তুলনামূলকভাবে কম। একটি ছোট প্লটে চাষ শুরু করতে ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ টাকার প্রয়োজন হয়, যার মধ্যে বীজ, জমি তৈরি এবং সরঞ্জামের খরচ অন্তর্ভুক্ত। জাতীয় ঔষধি উদ্ভিদ বোর্ড (NMPB) গিলয় সহ ৫৫টি ঔষধি উদ্ভিদের জন্য ৩০% এবং কিছু ক্ষেত্রে ৭৫% পর্যন্ত ভর্তুকি প্রদান করে, যা কৃষকদের জন্য অতিরিক্ত সুবিধা।

জৈব পদ্ধতিতে গিলয় চাষ
গিলয় চাষ জৈব কৃষির জন্য আদর্শ কারণ এটি সিন্থেটিক সার বা কীটনাশকের প্রয়োজন হয় না। গিলয় গাছ কম উর্বর মাটিতেও ভালোভাবে বেড়ে ওঠে এবং শুষ্ক বা পাহাড়ি অঞ্চলে চাষের জন্য উপযুক্ত। এটি জৈব সার, যেমন ভার্মিকম্পোস্ট, এবং প্রাকৃতিক কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির মাধ্যমে চাষ করা যায়। এই পদ্ধতি মাটির উর্বরতা বজায় রাখে এবং পরিবেশের উপর ক্ষতিকর প্রভাব কমায়।

Advertisements

গিলয়ের কাণ্ড কাটিং জুন-জুলাই মাসে রোপণের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। এটি নিম গাছের মতো সমর্থন গাছের সাথে চাষ করলে এর ঔষধি গুণ আরও বৃদ্ধি পায়। জৈব কৃষি পদ্ধতি ব্যবহার করে গিলয় চাষ কৃষকদের জন্য শুধু লাভজনকই নয়, বরং টেকসই কৃষি ও জৈব বৈচিত্র্য সংরক্ষণে অবদান রাখে।

সরকারি সহায়তা এবং বাজার সংযোগ
ভারত সরকার গিলয় চাষকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। জাতীয় ঔষধি উদ্ভিদ বোর্ড (NMPB) এবং প্রধানমন্ত্রী বন ধন বিকাশ যোজনার মাধ্যমে কৃষকদের আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, মহারাষ্ট্রের থানে জেলার কাটকারি সম্প্রদায়ের যুবক সুনীল পাওয়ার গিলয় চাষের মাধ্যমে ১৮০০ জনকে কর্মসংস্থান প্রদান করেছেন এবং বছরে ৫০ লক্ষ টাকার ব্যবসা করেছেন।

এছাড়া, এনএমপিবি’র ই-চরক প্ল্যাটফর্ম এবং মোবাইল অ্যাপ কৃষকদের জন্য একটি অনলাইন বাজার সরবরাহ করে, যেখানে তারা সরাসরি আয়ুর্বেদিক কোম্পানি, ফার্মাসিউটিক্যাল নির্মাতা এবং জৈব পণ্য ব্র্যান্ডের সাথে যুক্ত হতে পারে। এই ব্যবস্থা কৃষকদের জন্য নিশ্চিত বাজার এবং ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করে।

চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
গিলয় চাষে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যেমন বাজার সম্পর্কে অজ্ঞতা, প্রশিক্ষণের অভাব এবং প্রাথমিক বিনিয়োগের জন্য অর্থের সংকট। ওড়িশার একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ৭০০ জন কৃষকের মধ্যে অধিকাংশই ঔষধি উদ্ভিদ চাষের সম্ভাবনা সম্পর্কে অবগত নন। তবে, সরকারি প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং ভর্তুকি এই সমস্যার সমাধানে সহায়ক। কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং বাজার সংযোগের মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
গিলয় চাষ ভারতের জৈব কৃষকদের জন্য একটি স্বর্ণখনি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং জৈব পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে গিলয়ের বাজার আরও প্রসারিত হবে। এটি কেবল কৃষকদের আর্থিক স্বচ্ছলতাই আনবে না, বরং টেকসই কৃষি এবং পরিবেশ সংরক্ষণে অবদান রাখবে। সরকার, কৃষক এবং শিল্পের সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে গিলয় চাষ ভারতীয় কৃষির একটি নতুন অধ্যায় রচনা করতে প্রস্তুত।