বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন বিতর্ক ক্রমশ তীব্র হচ্ছে, ঠিক তখনই বিশ্বখ্যাত বিনিয়োগকারী মার্ক মোবিয়াস জানিয়েছেন যে, ভারতের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি মুক্ত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি (Bilateral Trade Agreement – BTA) অত্যন্ত উপকারী হবে। মোবিয়াসের মতে, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক (Modi Trump Ties ) এই চুক্তি বাস্তবায়নে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
মোবিয়াস, যিনি এমার্জিং মার্কেটের জন্য মোবিয়াস EM Opportunities ফান্ড পরিচালনা করেন, ইএএনএস-কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘‘বিশ্ব অর্থনীতি সাময়িকভাবে কিছুটা অস্থিরতার মুখোমুখি হবে। তবে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ট্রাম্প একাধিক দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি সই করতে শুরু করবেন। এতে বাজারে স্থিতি ফিরে আসবে এবং একটি বড় মন্দার আশঙ্কা অনেকটা কমে যাবে।’’
মোবিয়াসের মতে, ভারতের বেশ কিছু নন-টারিফ বাধা রয়েছে, যেমন কোয়ালিটি কন্ট্রোল ইনস্পেকশন এজেন্সির নিয়ম। তিনি বলেন, ‘‘ভারতের উচিত এই ধরনের সব বাধা দূর করা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করা।’’
বর্তমানে নয়া দিল্লি ও ওয়াশিংটন একটি প্রাথমিক দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি (BTA)-র প্রথম ধাপ সম্পূর্ণ করার জন্য কাজ করছে। লক্ষ্য, ২০২৫ সালের শেষ ভাগের মধ্যে শুল্ক হ্রাস করা। এর জন্য চুক্তির শর্তাবলী ইতিমধ্যেই চূড়ান্ত হয়েছে। দুই দেশই এই চুক্তি সময়মতো সম্পন্ন হলে পারস্পরিক লাভের আশা করছে।
মোবিয়াস বলেন, ‘‘একটি সম্পূর্ণ মুক্ত বাণিজ্য পরিবেশই সর্বোত্তম হবে। তবে বেশিরভাগ দেশ, বিশেষ করে চীন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (WTO) নিয়ম মানতে বা পারস্পরিক সুবিধার নীতি অনুসরণ করতে রাজি নয়।’’
তিনি আরও বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে পারস্পরিক সুবিধার (reciprocity) দাবি করছে, যাতে বাণিজ্যের ভারসাম্য রক্ষা করা যায় এবং প্রতিটি দেশে উৎপাদন খাতকে উৎসাহিত করা যায়।’’
এদিকে, চীনকে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করা পণ্যের ওপর ২৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। হোয়াইট হাউসের এক তথ্য বিবরণীতে জানানো হয়েছে, চীনের পাল্টা শুল্ক নীতির প্রতিক্রিয়ায় এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এর আগে চীন ঘোষণা করেছিল যে তারা আর নতুন বোয়িং বিমান গ্রহণ করবে না, যা যুক্তরাষ্ট্রের চীনা পণ্যের ওপর ১৪৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের জবাব হিসেবে এসেছে।
হোয়াইট হাউসের তথ্য অনুযায়ী, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প চীনের সঙ্গে একটি বাণিজ্য চুক্তি করতে ইচ্ছুক, তবে প্রথম পদক্ষেপটি চীনকেই নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য রাজনীতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র চীনের মতো বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলিকে WTO নিয়ম মানতে চাপ দিচ্ছে, অন্যদিকে চীন তাদের প্রতিরোধী নীতি বজায় রাখছে। এই প্রেক্ষাপটে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের উন্নতি ভারতের অর্থনৈতিক পরিকাঠামোতে নতুন দিশা দেখাতে পারে।
ভারতীয় রপ্তানিকারক ও উৎপাদকদের কাছে মার্কিন বাজার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে শুল্ক ও নন-টারিফ বাধার কারণে বহু পণ্য সহজে রপ্তানি করা যায় না। একটি সফল মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এ ক্ষেত্রে বড় সুবিধা এনে দিতে পারে। বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তি, টেক্সটাইল, ফার্মাসিউটিক্যালস, অটোমোবাইল এবং কৃষি খাতে রপ্তানির জন্য নতুন দরজা খুলে দিতে পারে।
অন্যদিকে, আমেরিকান কোম্পানিগুলোও ভারতীয় বাজারে আরও সহজে প্রবেশ করতে পারবে, যা প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করে ভারতীয় ভোক্তাদের জন্য আরও ভালো মানের এবং সাশ্রয়ী পণ্য ও সেবা নিশ্চিত করতে পারে। তবে এর জন্য ভারতের নন-টারিফ বাধা এবং অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণমূলক নীতিমালা সহজ করতে হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, মোবিয়াসের এই মন্তব্য শুধুমাত্র এক ব্যক্তির মতামত নয়, বরং এর মধ্যে রয়েছে ভবিষ্যতের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। ভারতের যদি সত্যিই একটি বড় অর্থনৈতিক লাফ দিতে হয়, তবে তাকে আন্তর্জাতিক বাজারে আরও উন্মুক্ত এবং প্রতিযোগিতামূলক হতে হবে। এবং এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি শক্তিশালী বাণিজ্য চুক্তি হতে পারে এক বড় পদক্ষেপ।
সব মিলিয়ে, মোবিয়াসের বার্তা ভারতের নীতিনির্ধারক এবং ব্যবসায়ী সমাজের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ দিশা নির্দেশ করছে। এখন দেখার বিষয়, ভারত সরকার এই বার্তা কতটা গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে এবং কত দ্রুত এই চুক্তি সম্পন্ন করতে পারে। তবে একথা স্পষ্ট যে, ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির পথ প্রশস্ত করাই হবে ভবিষ্যতের সঠিক কৌশল।