সজনের সৌজন্যে বিশ্বজুড়ে ভারতের দাপট

সজনে ফুলের বড়া কিংবা তরকারি—এই সাধারণ ঘরোয়া খাবারটি আজ বিশ্বের মঞ্চে ভারতের একটি গর্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে। বাঙালি রান্নার একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে সজনের ডাটা…

India Dominates Global Moringa Market

সজনে ফুলের বড়া কিংবা তরকারি—এই সাধারণ ঘরোয়া খাবারটি আজ বিশ্বের মঞ্চে ভারতের একটি গর্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে। বাঙালি রান্নার একটি অপরিহার্য অংশ হিসেবে সজনের ডাটা বা পাতা শুক্তোতে ব্যবহার করা হয়, কিন্তু এখন এই সাধারণ উপাদানটি ভারতকে গ্লোবাল মার্কেটে (Moringa Market) অগ্রণী হতে সাহায্য করছে। ভারত বিশ্বের মোরিঙ্গা (সজন) বাজারে ৮০% অংশ দিয়ে দাপট দেখাচ্ছে, যা এই দেশের কৃষি ক্ষেত্রের একটি অসাধারণ সাফল্যের পরিচয়। এই অর্থনৈতিক এবং পুষ্টিগত বিপ্লবের পেছনে রয়েছে ভারতের স্থানীয় চাষবাদের গভীর জড়িততা এবং ঐতিহ্যবাহী ব্যবহার, যা বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে।

সজনের উৎপাদনে ভারতের অগ্রগতি
এপিইডিএ (APEDA) এর তথ্য অনুযায়ী, ভারতের সজন উৎপাদনে আন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু এবং কর্ণাটকের অবদান সবচেয়ে বেশি, যা মোট উৎপাদনের ৮৯% এর বেশি নিয়ে নেয়। আন্ধ্রপ্রদেশে ৩৫.৯২%, তামিলনাড়ুতে ২৯.৯১% এবং কর্ণাটকে ২৩.৫৭% উৎপাদনের ভাগ রয়েছে। এই তথ্যগুলো দেখায় যে, দক্ষিণ ভারতের কৃষকরা কীভাবে প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য রেখে এই ফসলটিকে উৎপাদন করছেন। সজনের এই কেন্দ্রীভূত উৎপাদন ভারতকে গ্লোবাল মার্কেটে একটি কৌশলগত সুবিধা প্রদান করেছে। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সচেতনতার বৃদ্ধির সাথে সাথে সজনের চাহিদা বাড়ছে, এবং ভারত এই চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়েছে।

   

পুষ্টি এবং স্বাস্থ্যের সুবিধা
সজন বা মোরিঙ্গা ওলিফেরা একটি সুপরিচিত সুপারফুড হিসেবে গণ্য হয়। এর পাতায় ভিটামিন এ, সি এবং লোহিতের প্রাচুর্য রয়েছে, যা শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। বিজ্ঞানীদের গবেষণা (যেমন, ইলারাবানি প্রভৃতি, ২০২২) এর মাধ্যমে দেখা গেছে যে, সজনের অ্যান্টি-অবেসিটি এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট গুণ রয়েছে, যা ওজন কমানো এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। তবে, এই সুবিধাগুলোর পুরোপুরি নিশ্চিতকরণের জন্য বড় স্কেলের মানব চিকিৎসা পরীক্ষা এখনো সীমিত। সজনের এই পুষ্টিগত গুণাবলি বিশ্বব্যাপী চাহিদা বাড়িয়ে তুলেছে, বিশেষ করে স্বাস্থ্য সচেতন ব্যক্তিদের মধ্যে।

শুষ্ক প্রতিরোধী চাষের কৌশল
সজনের উৎপাদনে দক্ষিণ ভারতের অগ্রগতি একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফল। এই অঞ্চলের কৃষকরা শুষ্ক প্রতিরোধী চাষের মাধ্যমে সজনকে উৎপাদন করেন, যা জলাভাবের মতো প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েও সফল হয়েছে। এই প্রতিরোধ ক্ষমতা ভারতকে পশ্চিমা কৃষি রপ্তানির ওপর নির্ভরশীলতার ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে। ভারতের এই সক্ষমতা বিশ্বের স্বাস্থ্য খাদ্য প্রবণতার সাথে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। জলাভাবের মতো সমস্যার মধ্যেও সজনের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়া একটি আশ্চর্যজনক সাফল্য, যা ভবিষ্যৎ কৃষি পরিকল্পনায় অন্যান্য দেশগুলোর জন্য একটি মডেল হতে পারে।

Advertisements

বিশ্ববাজারে ভারতের ভূমিকা
বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য খাদ্যের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে সজনের বাজারও প্রসারিত হচ্ছে। ২০২২ সালে গ্লোবাল মোরিঙ্গা বাজারের মূল্য ছিল ৯.৫ বিলিয়ন ডলার, এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এটি ১৮.২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে, যা প্রায় ৮.৫% বার্ষিক বৃদ্ধিদর নির্দেশ করে (জায়ন মার্কেট রিসার্চ)। ভারত এই বাজারে প্রধান অংশ নিচ্ছে, এবং এর পেছনে রয়েছে স্থানীয় কৃষকদের কঠোর পরিশ্রম এবং সরকারি উৎসাহ। এই সাফল্য ভারতকে শুধু অর্থনৈতিকভাবে সুবিধা দিচ্ছে না, বরং বিশ্বের কাছে একটি স্থায়ী কৃষি মডেলের পরিচয়ও দিচ্ছে।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
সজনের জনপ্রিয়তা বাড়ার সাথে সাথে ভারতের কৃষি খাতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাদ্যের বাজারে ভারতের অবদান বাড়তে পারে, যদি গবেষণা এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে সজনের উৎপাদন এবং প্রক্রিয়াকরণ উন্নত করা যায়। তবে, এর জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং সরকারি সমর্থন প্রয়োজন। সজনের মাধ্যমে ভারত যদি বিশ্ববাজারে আরও পায়ের ছাপ রাখতে পারে, তবে এটি দেশের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান হবে।

সজনের এই অসাধারণ যাত্রা শুধু একটি খাদ্যের গল্প নয়, বরং ভারতের কৃষি শক্তি এবং সংস্কৃতির একটি গৌরবোজ্জ্বল প্রমাণ। এই সাধারণ ফসলটি আজ বিশ্বের সামনে ভারতের একটি অপরিহার্য ভূমিকা তুলে ধরেছে, যা ভবিষ্যতেও এই দেশের গল্পের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হবে।