বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্রুড অয়েলের দাম (Crude Oil Prices) শিগগিরই পুনরুদ্ধার করতে পারে। শনিবার বাজার বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সরবরাহপক্ষের ইতিবাচক ইঙ্গিত এবং ভূরাজনৈতিক উত্তেজনা হ্রাস পাওয়ার ফলে এ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যদিও বৈশ্বিক চাহিদার উদ্বেগ এখনও বাজারের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, তবুও অনেকেই মনে করছেন যে, গুরুত্বপূর্ণ টেকনিক্যাল স্তরগুলি বজায় থাকলে অয়েলের দাম আবার ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে।
পশ্চিম টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (WTI) ক্রুডের দাম শুক্রবারও নিম্নমুখী অবস্থায় ছিল। ছুটির দিনে লেনদেন কম হওয়া এবং বিশ্বব্যাপী দুর্বল চাহিদার কারণে দাম ৬৫ ডলার রেঞ্জের মাঝামাঝি স্থানে লেনদেন হয়েছে। তবে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতির পরিবর্তন হতে পারে। বিশেষ করে আসন্ন OPEC+ বৈঠক এবং মার্কিন শুল্কের সময়সীমার মতো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সামনে রয়েছে।
অ্যাঞ্জেল ওয়ান লিমিটেডের প্রধান টেকনিক্যাল গবেষণা বিশ্লেষক (পণ্য ও মুদ্রা) তেজস শিগরেকার জানিয়েছেন, “ক্রুড অয়েলের দৃষ্টিভঙ্গি এখনও মিশ্র হলেও সতর্ক আশাবাদ রয়েছে। বিশ্বব্যাপী উৎপাদন খাতে বিশেষ করে চীন এবং ইউরোজোনে ধীরগতির কারণে চাহিদা কিছুটা কমেছে। তবে, OPEC+ এর উৎপাদন কমানোর সিদ্ধান্ত এখনো বৈশ্বিক সরবরাহকে সীমিত করে রেখেছে।”
তিনি আরও বলেন, “সৌদি আরব এবং রাশিয়ার নেতৃত্বে যে উৎপাদন হ্রাস চলছে, তা মূলত বাজারে বড় ধরনের পতনকে আটকাতে সাহায্য করছে। এমনকি উন্নত দেশগুলির (OECD) কম চাহিদার পূর্বাভাসের মধ্যেও এই সমন্বিত উৎপাদন কেটে দেওয়ার পদক্ষেপ দামকে কিছুটা স্থিতিশীল রাখছে।”
বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত বড় কোনো সরবরাহ-সংকট না ঘটে, ততক্ষণ পর্যন্ত ক্রুডের ফিউচার দাম একটি সীমিত পরিসরের মধ্যেই থাকবে এবং কৌশলগত কেনার প্রবণতা তা সমর্থন করবে।”
একসময় যা দাম বাড়িয়ে তুলেছিল সেই ভূরাজনৈতিক ঝুঁকিও এখন কিছুটা কমেছে। ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির পর উত্তেজনা কমেছে। ইরান পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ চুক্তি (Nuclear Non-Proliferation Treaty)-তে নতুন করে প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় বিশ্ব বাজার কিছুটা শান্ত হয়েছে।
যদিও দক্ষিণ চীন সাগর এবং মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা এখনো রয়ে গেছে, তবে এখনও পর্যন্ত বৈশ্বিক সরবরাহ চেইনে বড় ধরনের কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি। ফলে বাজারের মধ্যে এক ধরনের স্থিতি ফিরতে শুরু করেছে।
এখন সকলের নজর ৫ জুলাই অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া OPEC+ বৈঠকের দিকে। ধারণা করা হচ্ছে, আগস্ট মাসের জন্য তৃতীয়বারের মতো ৪,১১,০০০ ব্যারেল দৈনিক উৎপাদন বাড়ানোর প্রস্তাব অনুমোদিত হতে পারে।
টেকনিক্যাল দিক থেকে বিশ্লেষণ করে শিগরেকার জানিয়েছেন, WTI ক্রুড যদি ৬২.৭০ ডলার সাপোর্ট স্তরের ওপরে থাকে, তবে দাম পুনরায় ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে। ভারতীয় বাজারের ক্ষেত্রে, ক্রুডের দাম যদি ৫,৭৮০-টাকার ওপরে যায়, তাহলে তা ৬,০০০ টাকা থেকে ৬,২০০ টাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। অন্যদিকে, যদি সাপোর্ট স্তর ৫,৫৫০-টাকার নিচে নেমে যায়, তবে দাম ৫,৩৩০ টাকা বা ৫,০০০ টাকা পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, “এই মুহূর্তে বাজারে চাহিদার ঘাটতি থাকলেও সরবরাহপক্ষের নিয়ন্ত্রণ এবং কৌশলগত মজুদের কারণে দাম একেবারে ভেঙে পড়বে না। বরং কিছুটা সীমিত ওঠানামার মধ্যেই থাকবে। দীর্ঘমেয়াদে দাম স্থিতিশীল রাখার জন্য বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যেই নিজেদের কৌশলগত রিজার্ভগুলো ব্যবহার করছে।”
বিশ্বজুড়ে মুদ্রানীতির কড়াকড়ি, বিশেষ করে ফেডারেল রিজার্ভের সুদের হার বৃদ্ধির কারণে অর্থনীতির গতি কিছুটা কমেছে। এর প্রভাবে জ্বালানি চাহিদা কমলেও, OPEC+ এর উৎপাদন হ্রাস নীতি বাজারের এক ধরনের নিরাপত্তা দিচ্ছে।
মোটের ওপর, বৈশ্বিক বাজারে ক্রুড অয়েলের ভবিষ্যৎ এখনও কিছুটা অনিশ্চিত। চাহিদার দিক থেকে একাধিক চ্যালেঞ্জ থাকলেও সরবরাহপক্ষের কৌশল এবং ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন বাজারকে নতুন গতি দিতে পারে। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে OPEC+ বৈঠক এবং মার্কিন অর্থনৈতিক নীতি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের পর ক্রুডের দাম আরও স্পষ্ট পথে অগ্রসর হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বিনিয়োগকারীদের প্রতি সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। বাজারের টেকনিক্যাল স্তর, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ইঙ্গিত এবং রাজনৈতিক খবরের ওপর চোখ রাখতে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে মধ্যমেয়াদে দাম কিছুটা ওঠানামা করলেও দীর্ঘমেয়াদে চাহিদার পুনরুদ্ধার এবং সরবরাহের সামঞ্জস্যই মূল ভূমিকা রাখবে বলে মত বিশ্লেষকদের।