পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষক বন্ধু প্রকল্প কৃষকদের জন্য একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ হিসেবে ২০১৯ সালে চালু হয়েছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে এই প্রকল্পটি রাজ্যের কৃষকদের আর্থিক সহায়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তা প্রদানের লক্ষ্যে গৃহীত হয়। ২০২১ সালে এটি ‘কৃষক বন্ধু (নতুন)’ (Krishak Bandhu Scheme) নামে পুনরায় চালু হয়, যেখানে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ বাড়ানো হয়। এই প্রকল্পের মাধ্যমে রাজ্যের প্রায় ৬৮ লক্ষ কৃষক এবং ভাগচাষী উপকৃত হয়েছেন। তবে, সব কৃষকই কি এই প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন? কারা বঞ্চিত হচ্ছেন? এই প্রতিবেদনে আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজব।
কৃষক বন্ধু প্রকল্পের উদ্দেশ্য ও সুবিধা
কৃষক বন্ধু প্রকল্পের মূল লক্ষ্য হলো কৃষকদের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রদান করা এবং তাঁদের কৃষি কার্যক্রমে সহায়তা করা। এই প্রকল্পের দুটি প্রধান উপাদান হলো:
১. আর্থিক সহায়তা: যে কৃষকদের এক একর বা তার বেশি জমি রয়েছে, তাঁরা বছরে ১০,০০০ টাকা (দুটি সমান কিস্তিতে ৫,০০০ টাকা করে খরিফ ও রবি মৌসুমে) পান। এক একরের কম জমির মালিকরা প্রতি বছর ন্যূনতম ৪,০০০ টাকা পান, যা প্রো-রাটা ভিত্তিতে প্রদান করা হয়।
২. মৃত্যু সুবিধা: ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সের মধ্যে কোনো কৃষকের মৃত্যু হলে তাঁর পরিবারকে এককালীন ২ লক্ষ টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়। এই সুবিধা দুর্ঘটনাজনিত বা স্বাভাবিক মৃত্যু উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
এই প্রকল্পের আর্থিক সহায়তা সরাসরি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ডিবিটি (ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার) পদ্ধতিতে প্রদান করা হয়, যা স্বচ্ছতা এবং সময়মতো অর্থ প্রদান নিশ্চিত করে। এছাড়া, কৃষক বন্ধু প্রকল্পের নিবন্ধিত কৃষকরা রাজ্য সরকারের ধান ক্রয় প্রকল্পে অগ্রাধিকার পান।
কারা উপকৃত হচ্ছেন?
২০২৪-২৫ রবি মৌসুমের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রায় ১ কোটি ৮ লক্ষ ৯৫ হাজার কৃষকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ২,৯৪৩ কোটি টাকা বিতরণ করছে। এই অর্থ খরিফ এবং রবি মৌসুমে কৃষি কার্যক্রমের জন্য বীজ, সার এবং অন্যান্য উপকরণ ক্রয়ে সহায়তা করবে। প্রধানমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ২০২৪ সালের জুন মাসে ঘোষণা করেন যে, খরিফ মৌসুমের জন্য ১.০৫ কোটি কৃষকের জন্য ২,৯০০ কোটি টাকা বিতরণ করা হবে। এই প্রকল্পে নিবন্ধিত কৃষকরা, বিশেষ করে যাঁদের কাছে জমির রেকর্ড অফ রাইট (RoR), পট্টা বা ভাগচাষের নথি রয়েছে, তাঁরা এই সুবিধা পাচ্ছেন।
২০২১ সালে তৃণমূল কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, আর্থিক সহায়তার পরিমাণ ৫,০০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০,০০০ টাকা করা হয়েছে, যা প্রায় ৬৮ লক্ষ কৃষকের জন্য একটি বড় স্বস্তি হিসেবে এসেছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে কৃষকরা ব্যক্তিগত ঋণদাতাদের উপর নির্ভরতা কমাতে পেরেছেন এবং তাঁদের কৃষি উৎপাদন বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন।
কারা বঞ্চিত হচ্ছেন?
যদিও কৃষক বন্ধু প্রকল্পটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত, তবুও কিছু কৃষক এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রধানত যাঁদের জমির মালিকানার নথি (RoR) বা পট্টা নেই, তাঁরা এই প্রকল্পের আওতায় আসতে পারছেন না। এছাড়া, অনেক ভাগচাষী (শেয়ারক্রপার) তাঁদের জমির মালিকানার প্রমাণ জমা দিতে ব্যর্থ হন, যার ফলে তাঁরা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নিবন্ধন প্রক্রিয়ার জটিলতা এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অ্যাক্সেসের অভাবও অনেক কৃষকের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অনেক ক্ষেত্রে, কৃষকরা তাঁদের আধার কার্ড বা ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সঙ্গে সঠিকভাবে লিঙ্ক না করার কারণে আর্থিক সহায়তা পেতে বিলম্বের সম্মুখীন হচ্ছেন। গ্রামীণ এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগের অভাব এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সীমাবদ্ধতাও এই প্রকল্পের সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে।
নিবন্ধন ও স্থিতি যাচাই প্রক্রিয়া
কৃষক বন্ধু প্রকল্পে নিবন্ধনের জন্য কৃষকদের স্থানীয় কৃষি দপ্তর বা পঞ্চায়েত অফিসে গিয়ে আবেদনপত্র জমা দিতে হয়। প্রয়োজনীয় নথির মধ্যে রয়েছে আধার কার্ড, ভোটার আইডি, জমির RoR, ব্যাঙ্ক পাসবুক এবং পাসপোর্ট সাইজের ছবি। অনলাইনে নিবন্ধনের জন্য কৃষকরা https://krishakbandhu.net ওয়েবসাইটে গিয়ে তাঁদের স্থিতি যাচাই করতে পারেন। ভোটার আইডি বা আধার নম্বর ব্যবহার করে সুবিধাভোগী তালিকা পরীক্ষা করা যায়। তবে, অনেক কৃষকের মধ্যে ডিজিটাল প্রক্রিয়া সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে।
সাম্প্রতিক আপডেট
২০২৪ সালের নভেম্বরে, রাজ্য সরকার ঘোষণা করে যে, ১ কোটি ৭ লক্ষ কৃষকের জন্য ২,৯০০ কোটি টাকা বিতরণ করা হবে। এই অর্থ রবি মৌসুমের জন্য ব্যবহৃত হবে। এছাড়া, ২০২৫-২৬ খরিফ মৌসুমের জন্য জুন মাসে ৫,০০০ টাকার প্রথম কিস্তি বিতরণ করা হবে। এই প্রকল্পের অধীনে কৃষকদের জন্য কৃষি ঋণের সুদের হার কমানো এবং ফসল বীমার প্রিমিয়াম সরকার কর্তৃক প্রদানের মতো অতিরিক্ত সুবিধাও পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ
কৃষক বন্ধু প্রকল্পটি কৃষকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও, এর বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নথিপত্রের অভাব, প্রযুক্তিগত জটিলতা এবং সচেতনতার ঘাটতির কারণে অনেক কৃষক এখনও এই প্রকল্পের সুবিধা থেকে বঞ্চিত। সরকারের উচিত গ্রামীণ এলাকায় আরও দুয়ারে সরকার ক্যাম্প আয়োজন করা এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা। এছাড়া, ভাগচাষীদের জন্য নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করা প্রয়োজন।
কৃষক বন্ধু প্রকল্প পশ্চিমবঙ্গের কৃষকদের জন্য একটি আশার আলো। এটি কৃষকদের আর্থিক স্বচ্ছলতা এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। তবে, সকল কৃষকের কাছে এই সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার জন্য সরকারকে আরও সক্রিয় হতে হবে। নথিপত্রের সহজলভ্যতা এবং প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর উন্নতি এই প্রকল্পকে আরও কার্যকর করতে পারে। রাজ্যের কৃষক সম্প্রদায়ের কল্যাণে এই প্রকল্পের সফলতা ভারতের কৃষি খাতে একটি উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।