কলকাতা: জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই নাড়ি কেটে ফেলার প্রচলিত ধারা এবার বদলাতে চলেছে। দেশের মধ্যে প্রথম কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাতেকলমে দেখাল—নাড়ি না কেটে, প্ল্যাসেন্টাসহ প্রসব ঘটালে শিশু (Newborn)আরও বেশি সুস্থ, সবল ও নীরোগ জন্মায়। শুধু তাই নয়, এতে সদ্যোজাতদের মধ্যে জন্ডিসের প্রবণতা হ্রাস পাচ্ছে এবং এসএনসিইউ (SNCU) সাপোর্টের প্রয়োজনও অনেক কমে যাচ্ছে।
বৃহস্পতিবার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের স্ত্রীরোগ বিভাগের তরফে এক চমকপ্রদ সমীক্ষা তুলে ধরা হয়। দেড়শো প্রসূতির উপর হওয়া এই পরীক্ষার মুখ্য গবেষক ছিলেন স্ত্রীরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. রামপ্রসাদ দে এবং নিওনেটাল বিভাগের ডা. দীনেশ মুন্যা। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মা ও শিশু স্বাস্থ্য উপদেষ্টা, প্রখ্যাত চিকিৎসক ডা. অরুণ সিং, চিত্তরঞ্জন সেবা সদনের অধ্যাপক ডা. আশিসকুমার মুখোপাধ্যায় এবং মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক ডা. তপনকুমার নস্কর।
সমীক্ষায় কী উঠে এল?
সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, অ্যাম্বিলিকাল কর্ড বা নাড়ি না কেটে, কিছুক্ষণ সময় দিয়ে দিলে শিশুর (Newborn) শরীরে প্ল্যাসেন্টা থেকে দ্রবীভূত অক্সিজেন এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ আরও ভালোভাবে পৌঁছে যায়। যার ফলে:
৯৪টি শিশুর অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছয় ৯০ শতাংশে।
মাত্র ৫১টি শিশুরই এসএনসিইউ সাপোর্ট লাগে। যেখানে সাধারণভাবে দ্রুত নাড়ি কাটা হলে প্রায় ৮০ শতাংশ শিশুকে SNCU-তে নিতে হয়।
মাত্র ১৮.৬ শতাংশ শিশুর জন্ডিস হয়েছে।
মাত্র ৭ জন শিশুর রেসপিরেটরি ডিসট্রেস হয়েছে।
৯৫.৩ শতাংশ শিশুর হার্টরেট এক মিনিটের মধ্যেই স্বাভাবিক মানে পৌঁছেছে।
এই সব তথ্যই প্রমাণ করে, নাড়ি না কেটে কিছুটা সময় অপেক্ষা করলে সদ্যোজাত শিশু অনেক বেশি সবল ও রোগ প্রতিরোধক্ষম হয়।
ডা. অরুণ সিং জানিয়েছেন, একটি সরকারি হাসপাতালে দিনে এক জন শিশুর জন্য SNCU খরচ প্রায় ২০ হাজার টাকা। অর্থাৎ যদি এসএনসিইউ-র প্রয়োজন কমে যায়, তাহলে সরকারের বিপুল খরচ সাশ্রয় হবে। ডা. সিং বলেন, “এই সমীক্ষা শুধু স্বাস্থ্য নয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নতুন দিশা দেখাবে।”
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ ডা. ইন্দ্রনীল বিশ্বাস বলেন, “এই সমীক্ষা আগামী দিনে শিশু প্রসবের রীতিতে বড় পরিবর্তন আনবে। পশ্চিমবঙ্গ আজ গোটা দেশের পথপ্রদর্শক হয়ে উঠছে।” তিনি আরও জানান, অন্যান্য রাজ্যেও এই পদ্ধতি প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এখনও পর্যন্ত চিকিৎসা ব্যবস্থায় জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই নাড়ি কেটে ফেলার চল প্রচলিত। তবে এই গবেষণা স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে, ‘ডিলেইড কর্ড ক্ল্যাম্পিং’ বা নাড়ি দেরিতে কাটা হলে শিশুর শরীরে রক্ত সঞ্চালন উন্নত হয়, ফুসফুসের কার্যকারিতা বাড়ে, এবং রোগ প্রতিরোধক্ষমতা অনেক বেশি থাকে।
এই গবেষণার ফলাফল প্রকাশ্যে আসার পরে চিকিৎসা মহলে ব্যাপক সাড়া পড়ে গিয়েছে। এই পদ্ধতি দেশজুড়ে স্বীকৃতি পেলে, ভারতীয় নবজাতকদের স্বাস্থ্যের মান আরও উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা। এখন দেখার, কেন্দ্র বা অন্যান্য রাজ্য কত দ্রুত এই মডেল গ্রহণ করে। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ এবার শিশুর জন্মে এনে দিল এক ঐতিহাসিক বিপ্লব।