ভারতে কেন হাজার হাজার কৃষক বাজরা চাষের দিকে ঝুঁকছেন?

২০২৫ সালে ভারতের কৃষি ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হাজার হাজার কৃষক (Farmers) ঐতিহ্যবাহী ধান, গম এবং ভুট্টার চাষ থেকে সরে এসে মিলেট…

Why Thousands of Farmers Are Switching to Millets in 2025: Climate Resilience and Economic Benefits

২০২৫ সালে ভারতের কৃষি ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হাজার হাজার কৃষক (Farmers) ঐতিহ্যবাহী ধান, গম এবং ভুট্টার চাষ থেকে সরে এসে মিলেট বা শস্য জাতীয় ফসলের দিকে ঝুঁকছেন। মিলেট, যেমন জোয়ার, বাজরা, রাগি, কাঙ্গনি, কোডো, এবং কুটকি, তাদের জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা, কম খরচ, এবং পুষ্টিগুণের জন্য ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। জাতিসংঘ কর্তৃক ২০২৩ সালকে ‘আন্তর্জাতিক মিলেট বছর’ ঘোষণার পর থেকে এই ফসলের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে, এবং ভারত, বিশ্বের বৃহত্তম মিলেট উৎপাদক হিসেবে, এই প্রবণতাকে আরও ত্বরান্বিত করছে। এই প্রতিবেদনে আমরা আলোচনা করব কেন কৃষকরা মিলেট চাষের দিকে ঝুঁকছেন এবং এর পিছনে অর্থনৈতিক, পরিবেশগত, এবং সামাজিক কারণগুলি কী কী।

মিলেট চাষের জনপ্রিয়তার কারণ
মিলেট চাষের দিকে কৃষকদের আগ্রহ বৃদ্ধির পিছনে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা। মিলেট ফসল খরা, উচ্চ তাপমাত্রা (৬৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত), এবং বন্যার মতো প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে পারে। ধান এবং গমের তুলনায় মিলেট উৎপাদনের জন্য অনেক কম জল এবং রাসায়নিক সারের প্রয়োজন হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি ধান গাছের জন্য যে পরিমাণ জল প্রয়োজন, তার তুলনায় মিলেট গাছের জন্য প্রায় ২.৫ গুণ কম জল লাগে। এটি বিশেষ করে ভারতের শুষ্ক এবং আধা-শুষ্ক অঞ্চলের কৃষকদের জন্য একটি আদর্শ ফসল।

   

দ্বিতীয়ত, কম উৎপাদন খরচ। মিলেট চাষে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশকের প্রয়োজন কম, যা কৃষকদের উৎপাদন খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে। এটি বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য লাভজনক, যারা প্রায়শই উচ্চ খরচের ফসল চাষে ঝুঁকি নিতে পারেন না। উদাহরণস্বরূপ, কর্ণাটকের শুষ্ক অঞ্চলে কৃষকরা ধান এবং আখের মতো জল-নির্ভর ফসল থেকে মিলেটের দিকে ঝুঁকছেন, যা তাদের খরচ কমিয়েছে এবং ফলনের নিশ্চয়তা বাড়িয়েছে।

তৃতীয়ত, পুষ্টিগুণ ও বাজারের চাহিদা। মিলেটে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, ফাইবার, ভিটামিন, এবং খনিজ পদার্থ রয়েছে, যা এটিকে স্বাস্থ্যকর খাদ্য হিসেবে জনপ্রিয় করেছে। এটি গ্লুটেন-মুক্ত এবং নিম্ন গ্লাইসেমিক ইনডেক্স সম্পন্ন, যা ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক মিলেট বছর ঘোষণার পর থেকে, ভারতে মিলেট-ভিত্তিক পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। মিলেট-ভিত্তিক স্ন্যাকস, সিরিয়াল, এবং বেকারি পণ্য এখন শহরাঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই ক্রমবর্ধমান চাহিদা কৃষকদের মিলেট চাষে উৎসাহিত করছে।

অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত সুবিধা
মিলেট চাষ কৃষকদের জন্য অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। এই ফসলের উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় কৃষকরা উচ্চ মুনাফা অর্জন করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ, ভারত সরকার মিলেট ফসলের জন্য ন্যূনতম সমর্থন মূল্য (MSP) বাড়িয়েছে, যা কৃষকদের আয়ের নিশ্চয়তা দিচ্ছে। এছাড়া, মিলেট চাষ পরিবেশের জন্যও উপকারী। এটি মাটির স্বাস্থ্য উন্নত করে, জৈব বৈচিত্র্য বৃদ্ধি করে, এবং কার্বন নিঃসরণ কমায়। ধানের তুলনায় মিলেট চাষে মিথেন নিঃসরণ অনেক কম হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সহায়ক।

Advertisements

সরকারি উদ্যোগ ও সমর্থন
ভারত সরকার মিলেট চাষকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ২০২৩ সালে শ্রী অন্না স্কিমের মাধ্যমে মিলেটের উৎপাদন ও খরচ বাড়ানোর লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। এই স্কিমের অধীনে হায়দ্রাবাদের ইন্ডিয়ান মিলেট রিসার্চ ইনস্টিটিউটকে শ্রেষ্ঠত্ব কেন্দ্র হিসেবে প্রমোট করা হচ্ছে। এছাড়া, অঙ্গনওয়াড়ি, স্কুলের মধ্যাহ্ন ভোজন, এবং আইসিডিএস প্রকল্পে মিলেট-ভিত্তিক খাবার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মিলেট রপ্তানির জন্যও সরকার মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিমা বাজারে প্রচার করছে। এই উদ্যোগগুলি কৃষকদের মিলেট চাষে উৎসাহিত করছে।

চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
মিলেট চাষের পথে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। প্রথমত, মিলেটের প্রক্রিয়াকরণ এবং সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব। ধান এবং গমের তুলনায় মিলেটের সরবরাহ শৃঙ্খল এখনও দুর্বল। দ্বিতীয়ত, কৃষকদের মধ্যে মিলেট চাষের প্রযুক্তিগত জ্ঞানের অভাব রয়েছে, বিশেষ করে পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার মতো ধান-নির্ভর রাজ্যে। তৃতীয়ত, মিলেটের বাজার মূল্য বছরে বছরে ওঠানামা করে, যা কৃষকদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে।
এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলায় সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাগুলি কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, কৃষকদের জন্য উচ্চ-ফলনশীল মিলেট বীজ সরবরাহ, প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট স্থাপন, এবং বাজার সংযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। মিলেট-ভিত্তিক পণ্যের প্রচারের জন্য শেফ এবং হোম কুকদের সঙ্গে সহযোগিতা করা হচ্ছে, যাতে গ্রাহকদের মধ্যে চাহিদা বাড়ে।

কৃষকদের জন্য সুযোগ
মিলেট চাষ কৃষকদের জন্য নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ তৈরি করছে। মিলেট-ভিত্তিক প্রক্রিয়াজাত পণ্য, যেমন মিলেট কুকিজ, ডোসা মিক্স, এবং স্ন্যাকস, শহরাঞ্চলে জনপ্রিয় হচ্ছে। মহিলা-নেতৃত্বাধীন স্বনির্ভর গোষ্ঠী (SHG) এবং তরুণ কৃষি উদ্যোক্তারা মিলেট ক্যাফে এবং প্রক্রিয়াকরণ ইউনিট চালাচ্ছেন, যা গ্রামীণ কর্মসংস্থান বাড়াচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ওড়িশা, তেলেঙ্গানা, এবং ছত্তিশগড়ের মতো রাজ্যে মিলেট-ভিত্তিক ব্যবসা কৃষকদের আয় বাড়াচ্ছে।

২০২৫ সালে মিলেট চাষের প্রতি কৃষকদের আগ্রহ বৃদ্ধি ভারতের কৃষি ক্ষেত্রে একটি টেকসই ভবিষ্যতের দিকে ইঙ্গিত করছে। জলবায়ু পরিবর্তন, জলের অভাব, এবং পুষ্টির ঘাটতির মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মিলেট একটি আদর্শ সমাধান। সরকারি সমর্থন, ক্রমবর্ধমান বাজার চাহিদা, এবং পরিবেশগত সুবিধার কারণে হাজার হাজার কৃষক মিলেট চাষের দিকে ঝুঁকছেন। এই প্রবণতা শুধুমাত্র কৃষকদের আয় বাড়াচ্ছে না, বরং টেকসই কৃষি এবং খাদ্য নিরাপত্তার জন্যও অবদান রাখছে। মিলেট চাষের এই পুনর্জাগরণ ভারতকে বিশ্বব্যাপী ‘মিলেট হাব’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে।