কৃষক উৎপাদক সংগঠন! ভারতীয় কৃষির ভবিষ্যৎ কি?

ভারতীয় কৃষি অর্থনীতির (Indian Agriculture) মেরুদণ্ড, যা দেশের প্রায় ৫০% জনগোষ্ঠীর জীবিকার প্রধান উৎস। তবে, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য কৃষি ক্রমশ অলাভজনক হয়ে উঠছে।…

Are Farmer Producer Organisations the Future of Indian Agriculture

ভারতীয় কৃষি অর্থনীতির (Indian Agriculture) মেরুদণ্ড, যা দেশের প্রায় ৫০% জনগোষ্ঠীর জীবিকার প্রধান উৎস। তবে, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য কৃষি ক্রমশ অলাভজনক হয়ে উঠছে। ছোট জমির আকার, বাজারে প্রবেশের সীমিত সুযোগ, উচ্চ উৎপাদন খরচ এবং মধ্যস্থতাকারীদের আধিপত্যের কারণে কৃষকরা তাদের ফসলের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। এই প্রেক্ষাপটে, কৃষক উৎপাদক সংগঠন (Farmer Producer Organisations বা FPOs) ভারতীয় কৃষির ভবিষ্যৎ হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। এফপিওগুলি কৃষকদের সমষ্টিগত শক্তির মাধ্যমে বাজারে প্রবেশ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং আয় বাড়ানোর একটি কার্যকর মাধ্যম হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু এফপিও কি সত্যিই ভারতীয় কৃষির ভবিষ্যৎ হতে পারে? এই নিবন্ধে আমরা এই বিষয়টি বিশ্লেষণ করব।

এফপিও কী এবং কীভাবে কাজ করে?
কৃষক উৎপাদক সংগঠন হলো এমন একটি সমষ্টিগত প্রতিষ্ঠান, যেখানে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা একত্রিত হয়ে তাদের উৎপাদন ও বিপণন কার্যক্রম পরিচালনা করে। এফপিওগুলি সাধারণত কোম্পানি আইন, ২০১৩-এর অধীনে নিবন্ধিত হয় এবং এটি সমবায় সমিতি ও বেসরকারি কোম্পানির মিশ্রণ। এর মূল উদ্দেশ্য হলো কৃষকদের সমষ্টিগত শক্তির মাধ্যমে বাজারে প্রবেশ, উৎপাদন খরচ কমানো, এবং ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা। এফপিওর মাধ্যমে কৃষকরা বীজ, সার, যন্ত্রপাতি এবং ঋণের মতো উৎপাদন সামগ্রী কম খরচে ক্রয় করতে পারে এবং তাদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি বাজারে বা বড় ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে পারে।

   

এফপিওর সুবিধা
এফপিওগুলি কৃষকদের জন্য একাধিক সুবিধা প্রদান করে। প্রথমত, এটি কৃষকদের বাজারে প্রবেশের সুযোগ বাড়ায়। ক্ষুদ্র কৃষকরা এককভাবে তাদের উৎপাদনের পরিমাণ কম হওয়ায় বড় বাজারে প্রবেশ করতে পারে না। এফপিওর মাধ্যমে তারা সমষ্টিগতভাবে তাদের উৎপাদন বাজারজাত করতে পারে, যা তাদের দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়ায়। দ্বিতীয়ত, এফপিও কৃষকদের উৎপাদন খরচ কমাতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, এফপিওর মাধ্যমে কৃষকরা বীজ, সার এবং কীটনাশক কম দামে কিনতে পারে। তৃতীয়ত, এফপিও কৃষকদের প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের সুযোগ প্রদান করে, যা তাদ生産ক্ষমতা বাড়ায়। উদাহরণস্বরূপ, মহারাষ্ট্রের সহ্যাদ্রি ফার্মস, একটি সফল এফপিও, ৮,০০০ কৃষকের সমন্বয়ে গঠিত এবং এটি ভারতের বৃহত্তম আঙ্গুর রপ্তানিকারক কোম্পানি হিসেবে পরিচিত। এটি ফল ও শাকসবজির বাজারে বিপ্লব ঘটিয়েছে।

সরকারি উদ্যোগ
ভারত সরকার এফপিওর প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ২০২০ সালে কেন্দ্রীয় সরকার ১০,০০০ এফপিও গঠনের জন্য ৬,৮৬৫ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে। এই প্রকল্পের অধীনে ইতিমধ্যে ১০,০০০ এফপিও গঠিত হয়েছে, যার সাথে প্রায় ৩০ লক্ষ কৃষক সংযুক্ত, যাদের মধ্যে ৪০% মহিলা। এছাড়া, এফপিওগুলি ২৫৪.৪ কোটি টাকার ইক্যুইটি গ্রান্ট এবং ৪৫৩ কোটি টাকার ক্রেডিট গ্যারান্টি পেয়েছে। স্মল ফার্মার্স অ্যাগ্রি-বিজনেস কনসোর্টিয়াম (এসএফএসি) এবং ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ফর এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট (নাবার্ড) এই প্রকল্পের প্রধান বাস্তবায়নকারী সংস্থা। এছাড়া, ২০১৮-১৯ সালের বাজেটে এফপিওদের জন্য পাঁচ বছরের কর ছাড় এবং ২০১৯-২০ সালের বাজেটে আরও ১০,০০০ এফপিও গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

এফপিওর চ্যালেঞ্জ
এফপিওর সম্ভাবনা থাকলেও এর বাস্তবায়নে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রথমত, পেশাদার ব্যবস্থাপনার অভাব। গ্রামীণ এলাকায় দক্ষ এবং প্রশিক্ষিত সিইও পাওয়া কঠিন, যা এফপিওর ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনায় বাধা সৃষ্টি করে। দ্বিতীয়ত, আর্থিক সীমাবদ্ধতা। ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পেতে এফপিওগুলি প্রায়শই জামানতের অভাবে ব্যর্থ হয়। তৃতীয়ত, ফসল কাটার পর সংরক্ষণ, পরিবহন এবং আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে ফসলের ক্ষতি হয়। এছাড়া, গুণমান মান এবং সার্টিফিকেশন প্রক্রিয়া জটিল এবং ব্যয়বহুল, যা ক্ষুদ্র এফপিওদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করে।

Advertisements

ভারতীয় কৃষির ভবিষ্যৎ হিসেবে এফপিও
এফপিওগুলি ভারতীয় কৃষির ভবিষ্যৎ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রথমত, এটি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের আয় বাড়াতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, এফপিও সদস্য কৃষকদের ফসলের ফলন, প্রতি একর আয় এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয়ত, এফপিও নারী কৃষকদের ক্ষমতায়ন করে এবং সামাজিক সম্পর্ক উন্নত করে। তৃতীয়ত, এটি আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন কৃষি ড্রোন, সেন্সর এবং এআই-ভিত্তিক নির্ভুল কৃষির প্রচলন ঘটায়। উদাহরণস্বরূপ, সহ্যাদ্রি ফার্মসের মতো এফপিও বড় বাজারের সাথে সংযোগ স্থাপন করে কৃষকদের আয় বৃদ্ধি করেছে।

তবে, এফপিওর সাফল্য নির্ভর করে সরকারি নীতি, আর্থিক সহায়তা এবং প্রশিক্ষণের উপর। সরকারকে এফপিওদের জন্য আরও সহজ ঋণ প্রক্রিয়া, আধুনিক সংরক্ষণ সুবিধা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া, ক্লাস্টার-ভিত্তিক ব্যবসায়িক সংগঠন (সিবিবিও) এবং বেসরকারি সংস্থাগুলির সাথে সহযোগিতা এফপিওদের শক্তিশালী করতে পারে।

কৃষক উৎপাদক সংগঠন ভারতীয় কৃষির ভবিষ্যৎ হিসেবে একটি শক্তিশালী সম্ভাবনা রাখে। এটি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য বাজারে প্রবেশ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং আয় বাড়ানোর একটি কার্যকর মাধ্যম। সরকারি উদ্যোগ, যেমন ১০,০০০ এফপিও গঠনের প্রকল্প, এই দিকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবে, পেশাদার ব্যবস্থাপনা, আর্থিক সহায়তা এবং প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর অভাব দূর করা গেলে এফপিওগুলি ভারতীয় কৃষিকে রূপান্তরিত করতে পারে। সঠিক নীতি ও সহায়তার মাধ্যমে এফপিও কৃষকদের আত্মনির্ভর ও সশক্ত করতে পারে, যা ভারতীয় কৃষির ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করবে।