জল ছাড়া কৃষি? ভারতে শুষ্ক ভূমি কৃষির উত্থান

ভারতের কৃষি জগতে শুষ্ক ভূমি কৃষি (Dryland Farming) একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং টেকসই সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, বিশেষ করে সেই অঞ্চলগুলিতে যেখানে জলের প্রাপ্যতা কম এবং…

Farming Without Water How Dryland Farming is Transforming Indian Agriculture

ভারতের কৃষি জগতে শুষ্ক ভূমি কৃষি (Dryland Farming) একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং টেকসই সমাধান হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, বিশেষ করে সেই অঞ্চলগুলিতে যেখানে জলের প্রাপ্যতা কম এবং বৃষ্টিপাত অনিয়মিত। ভারতের মোট চাষযোগ্য জমির প্রায় ৬৮% শুষ্ক ভূমির অন্তর্গত, যা দেশের খাদ্য উৎপাদনের প্রায় ৪৪% অবদান রাখে। এই কৃষি পদ্ধতি জলের উপর নির্ভরতা কমিয়ে প্রাকৃতিক বৃষ্টিপাত এবং মাটির আর্দ্রতা ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করে। জলবায়ু পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপের মধ্যে শুষ্ক ভূমি কৃষি ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা এবং কৃষকদের জীবিকা নির্বাহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এই প্রতিবেদনে আমরা শুষ্ক ভূমি কৃষির উত্থান, এর গুরুত্ব, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করব।

শুষ্ক ভূমি কৃষি কী?
শুষ্ক ভূমি কৃষি হলো এমন একটি কৃষি পদ্ধতি যেখানে সেচের পরিবর্তে প্রাকৃতিক বৃষ্টিপাত এবং মাটিতে সঞ্চিত আর্দ্রতার উপর নির্ভর করে ফসল উৎপাদন করা হয়। ভারতের শুষ্ক ভূমি অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৩৭৫ মিলিমিটার থেকে ১১২৫ মিলিমিটারের মধ্যে হয়, যা অত্যন্ত অনিয়মিত এবং অপ্রত্যাশিত। এই অঞ্চলগুলি প্রায়শই উচ্চ তাপমাত্রা, মাটির ক্ষয় এবং পুষ্টির ঘাটতির মতো সমস্যার সম্মুখীন হয়। শুষ্ক ভূমি কৃষিতে এই চ্যালেঞ্জগুলি মোকাবিলা করতে বিশেষ কৌশল এবং ফসলের জাত ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতি ভারতের রাজস্থান, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্ণাটক এবং তামিলনাড়ুর মতো রাজ্যগুলিতে ব্যাপকভাবে প্রচলিত।

   

শুষ্ক ভূমি কৃষির গুরুত্ব
ভারতের মোট চাষযোগ্য জমির প্রায় ৮০ মিলিয়ন হেক্টর শুষ্ক ভূমির অন্তর্গত, এবং এই অঞ্চলগুলি দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শুষ্ক ভূমি কৃষি থেকে প্রায় ৮০% ভুট্টা, ৯০% বাজরা, ৯৫% ডাল এবং ৭৫% তৈলবীজ উৎপাদিত হয়। এছাড়া, তুলা এবং মোটা শস্যের মতো ফসলও এই অঞ্চলে উৎপাদিত হয়। এই কৃষি পদ্ধতি শুধু খাদ্য উৎপাদনই নিশ্চিত করে না, বরং লক্ষ লক্ষ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের জীবিকা নির্বাহে সহায়তা করে।

শুষ্ক ভূমি কৃষি টেকসই কৃষির একটি মডেল হিসেবে বিবেচিত হয় কারণ এটি জল সংরক্ষণে সহায়তা করে এবং সিন্থেটিক সার ও রাসায়নিকের ব্যবহার কমায়। এটি মাটির স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় এবং পরিবেশের উপর নেতিবাচক প্রভাব হ্রাস করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্রমবর্ধমান খরা এবং অনিয়মিত বৃষ্টিপাতের প্রেক্ষাপটে এই কৃষি পদ্ধতি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

শুষ্ক ভূমি কৃষির কৌশল
শুষ্ক ভূমি কৃষির সাফল্য নির্ভর করে জল সংরক্ষণ এবং মাটির আর্দ্রতা ব্যবস্থাপনার উপর। এই পদ্ধতিতে ব্যবহৃত কিছু গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো:
১. মালচিং: মাটির উপর খড়, পাতা বা প্লাস্টিকের মতো জৈব বা অজৈব উপকরণ দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়, যা বাষ্পীভবন কমায় এবং মাটির আর্দ্রতা ধরে রাখে।
২. কনট্যুর প্লাউইং: ঢালু জমিতে মাটির ক্ষয় রোধ করতে এবং বৃষ্টির জল সংরক্ষণ করতে এই কৌশল ব্যবহৃত হয়।
৩. খরা-সহিষ্ণু ফসল: বাজরা, জোয়ার, রাগি, চিনা, মুগ, ছোলা এবং তিলের মতো ফসল যা কম জলেও বেঁচে থাকতে পারে, শুষ্ক ভূমি কৃষিতে জনপ্রিয়।
৪. ফসল ঘূর্ণন এবং মিশ্র ফসল: বিভিন্ন ফসলের ঘূর্ণন এবং একই জমিতে একাধিক ফসল চাষ মাটির উর্বরতা বজায় রাখে এবং জলের ব্যবহার কমায়।
৫. জল সংগ্রহ: বৃষ্টির জল সংরক্ষণের জন্য জলাশয় এবং ওয়াটারশেড ব্যবস্থাপনা ব্যবহৃত হয়, যা শুষ্ক মৌসুমে ফসলের জন্য জল সরবরাহ করে।

সরকারি উদ্যোগ এবং সমর্থন
ভারত সরকার শুষ্ক ভূমি কৃষিকে উৎসাহিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ১৯৭০ সালে ভারতীয় কৃষি গবেষণা পরিষদ (ICAR) ‘অল ইন্ডিয়া কোঅর্ডিনেটেড রিসার্চ প্রোজেক্ট ফর ড্রাইল্যান্ড এগ্রিকালচার’ (AICRPDA) চালু করে, যা স্থানীয়ভাবে উপযোগী গবেষণার মাধ্যমে শুষ্ক ভূমি কৃষির উন্নতি ঘটিয়েছে। ১৯৮৫ সালে হায়দ্রাবাদে সেন্ট্রাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর ড্রাইল্যান্ড এগ্রিকালচার (CRIDA) প্রতিষ্ঠিত হয়, যা জল সংরক্ষণ, মাটির স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এবং ফসলের জাত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

Advertisements

এছাড়া, সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প যেমন প্রধানমন্ত্রী কৃষি সিঞ্চন যোজনা (PMKSY), জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা মিশন এবং জাতীয় বাগান মিশন শুষ্ক ভূমি কৃষির উন্নয়নে সহায়তা করছে। ২০১৮ সালে ‘মিলেট বর্ষ’ ঘোষণার মাধ্যমে সরকার বাজরা, জোয়ার এবং রাগির মতো শুষ্ক ভূমির ফসলের প্রচারে উৎসাহিত করেছে। জাতীয় বৃষ্টিনির্ভর এলাকা কর্তৃপক্ষ (NRAA) এবং ওয়াটারশেড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামগুলি কৃষকদের প্রশিক্ষণ এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করছে।

চ্যালেঞ্জ এবং সমাধান
শুষ্ক ভূমি কৃষির প্রধান চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে রয়েছে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, মাটির ক্ষয়, পুষ্টির ঘাটতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। এই অঞ্চলগুলিতে ফসলের উৎপাদনশীলতা কম এবং ফসল ব্যর্থতার ঝুঁকি বেশি। তবে, আধুনিক প্রযুক্তি এবং কৃষি গবেষণা এই সমস্যাগুলির সমাধানে সহায়তা করছে। উদাহরণস্বরূপ, খরা-সহিষ্ণু ফসলের জাত উন্নয়ন, ড্রিপ এবং স্প্রিঙ্কলার সেচের মতো মাইক্রো-ইরিগেশন সিস্টেম, এবং সেন্সর ও ড্রোনের মাধ্যমে নির্ভুল কৃষি এই কৃষি পদ্ধতির উৎপাদনশীলতা বাড়াচ্ছে।

এছাড়া, সমন্বিত পুষ্টি ব্যবস্থাপনা, জৈব সারের ব্যবহার এবং সমন্বিত কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা মাটির উর্বরতা এবং ফসলের গুণমান উন্নত করছে। কৃষকদের জন্য প্রশিক্ষণ এবং আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে সরকার এই পদ্ধতির প্রসারে কাজ করছে। ইসরায়েলের মতো দেশগুলির শুষ্ক ভূমি কৃষির সফল মডেল থেকে শিক্ষা নিয়ে ভারতও এই ক্ষেত্রে আরও উন্নতি করতে পারে।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
জলবায়ু পরিবর্তন এবং জলের অভাব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুষ্ক ভূমি কৃষির গুরুত্ব আরও বাড়বে। ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা এবং গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়নে এই কৃষি পদ্ধতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। আধুনিক প্রযুক্তি, গবেষণা এবং সরকারি নীতির সমন্বয়ে শুষ্ক ভূমি কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ানো সম্ভব। কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং টেকসই কৃষি পদ্ধতির প্রচারের মাধ্যমে এই অঞ্চলগুলি আরও সমৃদ্ধ হতে পারে।

শুষ্ক ভূমি কৃষি ভারতের কৃষি অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জলের অভাব এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, এই পদ্ধতি কৃষকদের জীবিকা এবং দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। সঠিক প্রযুক্তি, সরকারি সমর্থন এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শুষ্ক ভূমি কৃষি ভারতের কৃষি জগতে একটি নতুন বিপ্লব আনতে পারে।